৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হুমকি
৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হুমকি
লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুথি গোষ্ঠীর ক্রমাগত হামলার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে। সমুদ্র পথে জাহাজ যোগে পণ্য পরিবহন করতে এখন এশিয়া থেকে ইউরোপ-আমেরিকাগামী জাহাজগুলো বিকল্প পথ ব্যবহার করছে। ঘুরপথে জাহাজ পরিচালনা করতে গিয়ে লাগছে বাড়তি সময় ও খরচ। ইতিমধ্যে শিপিং লাইনগুলো আপৎকালীন সারচার্জ যোগ করেছে অতিরিক্ত প্রায় ৪০ শতাংশ। এর প্রভাবে দেশের পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। যা কোনো না কোনভাবে দেশের ভোক্তা পর্যায়ে বহন করতে হবে। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে।
যদিও দেশের শিপিং এজেন্টগুলো বলছে বিদেশি প্রিন্সিপাল কোম্পানিগুলো তাদের অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নিতে খরচ বাড়িয়েছে। তাই আমদানি-রপ্তানির বুকিংয়ে বর্ধিত হরেই চার্জ আদায় করতে হচ্ছে।
এদিকে, বর্ধিত জাহাজ ভাড়াসহ অতিরিক্ত চার্জ আদায়ে ব্যবস্থা নিতে শনিবার (২৭ জানুয়ারি) অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ।
সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞগণের মতে, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ৬১ শতাংশ রপ্তানিপণ্য পৌঁছাতে সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। একইসাথে দেশের মোট আমদানিপণ্যের ৮ শতাংশ পরিবহন হয় এই পথে। বিশ্বের ব্যস্ততম সুয়েজ খালনির্ভর এই পথে বাংলাদেশের প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের (৪০ বিলিয়ন) বাণিজ্য সম্পন্ন হয়।
তবে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুথিদের ক্রমাগত হামলার কারণে বিশ্বের বৃহৎ শিপিং কোম্পানিগুলো এখন আর এই পথ ব্যবহার করছে না। সুয়েজ খাল ব্যবহার করে ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব জাহাজ চলাচল করে, এই হামলার কারণে ওই জাহাজগুলোকে গতিপথ পরিবর্তন করতে হয়েছে।
এখন ঘুরপথে আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে গন্তব্যে যেতে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার বাড়তি পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। এতে সময় লাগছে অতিরিক্ত ১১ দিন। আসা-যাওয়ায় প্রতিটি জাহাজ পাড়ি দিচ্ছে অতিরিক্ত প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার। অতিরিক্ত সময় লাগছে ২২ দিন।
বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য, পেট্রোলিয়াম, এলএনজি, ভোজ্যতেল, চিনি, গম, চাল, শিল্পের কাঁচামাল, তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল, কেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যালস কাঁচামালসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করতে হয়। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানাগুলোর কাঁচামালও আমদানি হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। সেসব পণ্য তৈরি করে আবার একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে হয়। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকশিল্প, ওষুধ, হ্যান্ডিক্রাফট, ফ্রোজেন ফুড, চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে। সমুদ্রপথ ব্যবহার করেই এসব আমদানি-রপ্তানি হয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে প্রতিটি সেকেন্ড কাউন্ট করা হয় ডলার হিসেবে। এখন ঘুরপথের প্রভাবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে সমুদ্রপথে পণ্য না পেলে তখন এয়ার শিপমেন্টকে বেছে নেবে। এক্ষেত্রে জাহাজের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি ফ্রেইট খরচ গুনতে হবে।
সংকটের সমাধানে করণীয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোওয়ার্ডার্স এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও এফবিসিআই’র পোর্ট এন্ড শিপিং স্ট্যান্ডিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান খায়রুল আলম সুজন বলেন, সমুদ্রপথের এই সংকটে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে, সেসব দেশ একত্রিত হয়ে ইউনিটি গড়ে তোলা যেতে পারে। দেশগুলোর সাথে আলোচনা করে সমুদ্র পথ, সাপ্লাই চেইন যাতে নিরাপদ রাখা যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে সব দেশকে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে না। দেশের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ার শংকা তুলনামূলক কম হবে। এসব সংকট সমাধানে প্রয়োজনে আন্তঃদেশীয় সংলাপ করা যেতে পারে। বিভিন্ন দেশ একত্রিত হয়ে যদি সংকট সমাধানে ঐকমত্য গঠন করতে পারে, তাহলে হয়তো সমুদ্রপথের এসব অস্থিরতা দূর করা সম্ভব হবে।