অর্থনীতি

৫০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, গত ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ সময়ে পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ কোটি টাকার বেশি। গতকাল সোমাবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বিকল্প বাজেট প্রস্তাবকালে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

সমিতি আগামী অর্থবছরের জন্য ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট উপস্থাপন করেছে। এবার বিকল্প বাজেটের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মিলনায়তনে ‘বিকল্প বাজেট প্রস্তাব ২০২৪-২৫ : উন্নত বাংলাদেশ অভিমুখী বাজেট’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মো. আইনুল ইসলাম বিকল্প বাজেট উপস্থাপন করেন। এ সময় অর্থনীতি

সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. আবুল বারকাত উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে বিকল্প বাজেটের প্রস্তাবে বলা হয়, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত গত ৫০ বছরে বিদেশে পাচার হয়েছে ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। এর উদ্ধার করার সুপারিশ করা হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ অর্থ, যার পরিমাণ হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া এই ৫০ বছরে পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৪৪ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ অর্থ উদ্ধারের সুপারিশ করা হয়েছে। আর রাজস্ব খাত থেকে আসবে ১০ লাখ ২৪ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা।

সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন সম্পর্কে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি জানায়, বিগত কয়েক বছরে বাজেট বাস্তবায়নের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথম ৩ মাসে বাজেট ৫-৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়। ৬ মাসে এ বাস্তবায়ন হয় ১৪-১৫ শতাংশ। ৯ মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হয় ২৬-২৭ শতাংশ। বছরের শেষের দিকের এক দেড় মাসে অনেক খরচ করা হয় এবং এ সময়ে বাজেট বাস্তবায়নের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৫ শতাংশের বেশি।  অর্থবছরের শেষের দিকে এত টাকা তাড়াহুড়ো করে খরচ হওয়ায় কাজের মান খারাপ হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই তাড়াহুড়ার কারণে বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করার বড় ধরনের সুযোগ থাকে। বছরের শুরু থেকে বাজেট বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ার মতো। এর পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা রীতিমতো উদ্বেগজনক।

কালো টাকা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, কালো টাকা উদ্ধারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। অর্থনীতিকে পরিচালিত করে রাজনীতি। সঠিক লাইনে ব্যবস্থা নিলে পদ্ধতি আছে। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম অন্যতম। এটা শতভাগ করতে পারলে কালো টাকার অবস্থান বের করা সম্ভব। তিনি বলেন, কালো টাকা বহু জায়গায় অবস্থান করছে। অর্থ মন্ত্রণালয় একটি গবেষণা করেছিল, যা প্রকাশ হয়নি। সেখানে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির ৩৩ থেকে ৬৬ শতাংশ হতে পারে। অর্থনীতি সমিতি প্রতি বছরে গড়ে ৩৩ শতাংশের মতো কালো টাকার হিসাব দিয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, দুষ্টচক্র পেঁয়াজ, আলু ও ডলারের বাজারে যেমন আছে, তেমনি ব্যাংক খাতেও আছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি অনেক কর্মী। সব জায়গায় বিরাজ করছে দুষ্টচক্র। যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে চাই, তাহলে আগে এই দুষ্টচক্রকে রোধ করতে হবে। তা না হলে তারা যেভাবে বিভিন্ন বাজার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে, আমাদের অগ্রগতি হবে না। সরকার যেটা চাচ্ছে, সেটাও হবে না। আমরা চাই দুষ্টচক্রকে দমন করে এগিয়ে যেতে।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য খাত এখন বৈষম্য সৃষ্টি ও দারিদ্র্য সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম। আর করোনা প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, আমাদের দেশে আসলেই তেমন কোনো শক্তিশালী স্বাস্থ্য খাত নেই। স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান (২০২৩-২৪ অর্থবছরে) সরকারি বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা। আমরা এ বরাদ্দ ১ দশমিক ৯৪ গুণ বৃদ্ধি করে ৭৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করছি। আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হলো- স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান ডাইরেক্টরেটের পাশাপাশি আরও একটি ডাইরেক্টরেট প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার নাম হবে ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ডাইরেক্টরেট’।

অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবে আয়ের উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে আয়ের মধ্যে মুনাফা ও মূলধনের ওপর ২ লাখ ৬০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, সম্পদ কর ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা, অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর ৭৫ হাজার ২০০ কোটি, বিলাসী দ্রব্যে আমদানি শুল্ক ৮৫ হাজার, মদের শুল্ক ৫ হাজার ২০০ কোটি, কালো টাকা থেকে প্রাপ্তি ১০ হাজার কোটি ও অর্থ পাচার উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি ৫ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে বিকল্প বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৯৬ কোটি এবং রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ ২৪ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। প্রস্তাবে বলা হয়, ঘোষিত বাজেট সম্প্রসারণশীল বাজেট। যেখানে সুপারিশ সংখ্যা ছিল ৩৬১টি। এখানে ২৪টি মূল পয়েন্টের উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিকল্প বাজেট সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও কনফারেন্সে দেশের ৬৪টি জেলা, ১৩৫টি উপজেলা এবং ৪৫টি ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিরা ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকেন। এর আগে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট পেশ করেছিল বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। ফলে এবার বিকল্প বাজেটের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমিয়েছে সমিতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *