৫২ বছর পর বধ্যভূমি পেল ফুলেল শ্রদ্ধা
সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনে অবস্থিত শত শত শহীদের গণকবর। সবার মুখে মুখে সেই বধ্যভূমির গল্প জানা থাকলেও কেউ উদ্যোগ নেননি। কোনোদিন শ্রদ্ধার ফুলও দেয়নি কেউ সে গণকবরে। ফুল দেওয়াতো দূরের কথা, জনমানবের যাতায়াত ছিল না সেখানে। ফলে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছিল এ বধ্যভূমি।
অবশেষে সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনের সে গণকবর বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায় ৫২ বছর পর। ৭২ শহীদের স্মৃতিচিহ্ন আবিস্কৃত হয়। এরমধ্যে ৬৬ শহীদের পরিচয় মিলে। বাকিদের পরিচয় এখনও অজানা।
যে বধ্যভূমিতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন শহীদ সিরাজুল আবদাল, শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ, সিলেট মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এফ জিয়াউর রহমানসহ বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি।
হারিয়ে যেতে বসা শহীদদের সমাধিতে প্রথম ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এ বছরের ৪ মার্চ।
স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ ও উদ্যোক্তা কমিটি সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনের গহীন জঙ্গলে থাকা গণকবরকে সংরক্ষণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান নামকরণ করে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এটা একমাত্র স্মৃতি উদ্যান, যাতে শহীদদের নাম অনুসন্ধান করে সন্নিবেশিত করা হচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হয়েছে উদ্যানটি। এবারই প্রথমবারের মতো জানানো হয় শ্রদ্ধা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল সেখানে এখন সিলেট ক্যাডেট কলেজ। কলেজের পেছনে পূর্বদিকের টিলার পাশে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকহানাদাররা। সংখ্যায় সেটি কত, তা আজও অজানা।
শহীদ স্মৃতি উদ্যান বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পত্র-পত্রিকা, গবেষণাগ্রন্থ এবং মাঠপর্যায়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিটি শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এ পর্যন্ত ৬৬ শহীদের নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। নতুন কোনো শহীদের তথ্য পেলে তা সংযুক্ত হবে এ স্মৃতি উদ্যানে।
তিনি বলেন, বিশাল চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ। একটি স্তম্ভে রয়েছে এখানে শায়িত সব শহীদের নাম। সব শহীদের জন্য কবরের আদলে আলাদা আলাদা স্মৃতিফলক। ফুল আর গাছে গাছে আচ্ছাদিত পুরো চত্বরের বিভিন্ন স্থানে এ উদ্যান নির্মাণের পটভূমি, এখানে শায়িত সব শহীদদের জীবনী লেখা রয়েছে। এ স্মৃতি উদ্যানে পাঠাঘার, জাদুঘর, কফিশপ এবং আলাদা বসার জায়গা নির্মাণ করা হবে।
শহীদ স্মৃতি উদ্যান উদ্যোক্তা ও নির্মাতাদের মধ্যে রয়েছেন কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বিপি (অব.), ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। আর সহযোগিতায় রয়েছেন, চৌধুরী, মো. আব্দুল হাফিজ চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিন আহমেদসহ আরও অনেকে। তাদের সঙ্গে স্মৃতিস্তম্ভ বাস্তবায়ন কমিটির আরেক সদস্য মুক্তিযোদ্ধ গবেষক সাংবাদিক অপূর্ব শর্ম্মা।
এ বছরের ৪ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধন করেন শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল। লাল ফিতা কেটে স্বামীসহ ৬৬ শহীদের স্মৃতিচিহ্ন উদ্বোধন করেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ওইদিনই প্রথম শহীদ পরিবারের সদস্যরা অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মৃতিচিহ্নে এসে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সেদিন স্বজনহারাদের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠেছিল সিলেট ক্যাডেট কালেজের পেছনের অবস্থিত নতুন পরিচয় পাওয়া এ বধ্যভূমি।
শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল বলেন, আমার স্বামীর কোনো স্মৃতি চিহ্ন ছিল না। বধ্যভূমিতে স্বামীর স্মৃতিচিহ্ন টুকু পরম পাওয়া। তাই মৃত্যুর আগে স্বামীর স্মৃতিচিহ্ন দেখে সেদিন কেঁদেছিলেন তিনি।
সালুটিকরের এ গণকবরটি বধ্যভূমি হিসেবে জানলেও এতদিন এটি পড়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এ টিলা ভূমিতে গণকবরে ছিল না কোনো স্মৃতিচিহ্নও। সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় এ বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল না।
অবশেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দুই মুক্তিযোদ্ধার উদ্যোগে এ বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের উদ্যোগেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক শহিদ স্মৃতি উদ্যান।