চট্টগ্রাম

৮ টাকার ইনজেকশন ১০০!

অপারেশনের আগে রোগীর চেতনানাশের জন্য ব্যবহার হয় নিওসুক্সাস (Neosuxa) ইনজেকশন। এটির খুচরা বাজারমূল্য মাত্র ৮ টাকা ৪৩ পয়সা। কিন্তু এই ইনজেকশন এক টাকা দু’টাকা নয়, পুরো ৯২ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পূর্ব গেইটে। ‘ইমন মেডিকেল হল’ নামে একটি ফার্মেসিতে রোগীর এক স্বজনের হাতে ধরা পড়েছে এ ‘জোচ্চুরি’। তবে শুধু ইমন ফার্মেসি নয়, ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মেরে রোগীর পকেট হাতিয়ে দেওয়ার হরহামেশা অভিযোগ রোগীর স্বজনদের।

অভিযোগ আছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের পূর্ব এবং পশ্চিম গেইটের আশপাশের বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে ওষুধের দাম নিয়ে নৈরাজ্য যেন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। সরকারি এই হাসপাতালে দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় সহজ-সরল রোগীর স্বজনদের ‘পকেট কেটেই’ চলে তাদের বাণিজ্য। কখনো কখনো রোগীর স্বজনদের হাতে ধরা পড়লেও ‘বুক ফুলিয়ে’ তাদের সঙ্গে জড়ান ‘বাদানুবাদে’। জরুরি মুহূর্তে দেন ওষুধ না বেচার হুমকি-ধমকি।

শনিবার (২৯ জুন) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে জরায়ুর টিউমারের অপারেশন করান রুনা আক্তার। অপারেশনের একদিন আগে গত শুক্রবার বিকেলে ওই নারীর স্বজনদের কিনতে দেওয়া হয় ওষুধ ও অপারেশন সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামের তালিকা। মোটামুটি সব ওষুধ কেনা হলেও বাদ থেকে যায় নিওসুক্সাস (Neosuxa) নামে ইনজেকশনটি।

সেই ইনজেকশন কিনতে রুনা আক্তারের স্বামী জাহাঙ্গীর আলম ঘোরেন মেডিকেলের পূর্ব গেইটের কয়েকটি ফার্মেসিতে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও ইনজেকশনটি না পেয়ে তিনি সবশেষে যান পূর্ব গেইটের বিপরীতের ‘ইমন মেডিকেল হল’ নামে ফার্মেসিতে। মেডিকেলের নার্স আগেই বলে দিয়েছেন ইনজেকশনের দাম নেওয়া হবে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। কিন্তু ইমন মেডিকেল হলে গিয়ে দাম শুনে জাহাঙ্গীরের চক্ষু চড়কগাছ। চেতনানাশক ওই ইনজেকশনের দাম চাওয়া হয়েছে তার কাছে ১০০ টাকা!

একইসময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এই প্রতিবেদক। ফার্মেসির ওই কর্মচারীর কাছে কয়েকবার ইনজেকশনটির সঠিক দাম জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রতিবারই উত্তর দেন ১০০ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যের ওয়েবসাইট মেডএক্স (MedEx) এ প্রবেশ করে ওষুধের নির্ধারিত দাম লেখা থাকলে তিনি জানান, ‘ওখানে লেখা থাকলেও দাম ১০০ টাকাই, কম হবে না।’

এরপর প্রতিবেদক তার পরিচয় দিলেই দোকানি বদলায় সুর। বলেন, ‘দুঃখিত, আমি পুরো প্যাকেটের দাম চেয়েছিলাম ভুলে। এটির দাম ১৫ টাকা।’ নির্ধারিত দাম অনুযায়ী পুরো প্যাকেটের দামও ১০০ টাকা হয়না—প্রতিবেদকের এমন পাল্টা প্রতুত্যরে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই, আমি কর্মচারি। মালিক জানে সব।’ এরপরই তিনি ব্যস্ত হয়ে যান অন্য ক্রেতাদের সাথে।

ইনজেকশন কিনতে আসা জাহাঙ্গীর আলম সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘এই দেশে যে যেভাবে পারে করে। ৮ টাকার ইনজেকশন ১০০ টাকা। এটা কেমন কথা? আমরা সহজ-সরল বাবা। এসব বুঝি না। তাই বলে ১০ গুণ বেশি দাম রাখবে সুযোগ পেয়ে? এগুলো দেখার আসলে কেউ নাই। যারা দেখার তাদের কেবল মাস শেষে বেতন পেলেই চলে। আর আমাদের মত অসহায়রা মরে যাক, অসুবিধে নেই।’

‘এর আগে মেডিকেল থেকে প্রেসক্রিপশানে দেওয়া আলট্রাকার্বন নামে একটি ওষুধ কিনতে যাই আরেকটি ফার্মেসিতে। বলা হয়েছিলো ওটার দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকা। কিন্তু আমার কাছ থেকে এক একটি ট্যাবলেটের দাম রাখা হয়েছে ৬০ টাকা করে।’— অভিযোগ করেন তিনি।

অনিবন্ধিত ওষুধেরও ‘সওদাগরি’ ইমন ফার্মেসিতে

গত ২ মে রাতে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম মেডিকেলের সামনের ফার্মেসিগুলোয় অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও চান্দগাঁও সার্কেল ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইউছুফ হাসান। এসময় তিনি ওই ‘ইমন মেডিকেল হল’ ও ‘সাহান মেডিকো’ নামে দুটি ফার্মেসি থেকে জব্দ করেন দেড় লাখ টাকার অনিবন্ধিত বিদেশি ওষুধ।

অবৈধ এসব ওষুধ রাখার দায়ে ২০ হাজার টাকা করে ওই দুই ফার্মেসিকে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। কিন্তু এরপরেও ইমন মেডিকেল হল নিয়মিত ‘পকেট কাটছে’ রোগীর স্বজনদের।

রাত ১২টায় রোগীর স্বজনদেরও ১২টা

অভিযোগ এসেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পূর্ব গেইটের একাধিক ফার্মেসিতে সারাদিন ওষুধের দাম বাড়তি নিলেও রাত ১২টার পর তা বেড়ে যায় দ্বিগুণ বেশি। রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাতে অনেকসময় জরুরি রোগী আসে চিকিৎসা নিতে। এসময় তাদের হাতে মেডিকেলের যে ওষুধের স্লিপ দেওয়া হয় সেটি ফার্মেসিগুলোতে নিয়ে গেলে নির্ধারিত দামের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি দাম রাখা হয়। আর রোগীর স্বজনরাও বাধ্য হয়েই সেই বাড়তি দামে ওষুধ কেনেন।

৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি বিলকিস নামে এক রোগীর স্বামী জানান, তিনি তার স্ত্রীকে গত বুধবার ভর্তি হয়েছেন ডেলিভারি অপারেশনের জন্য। রাত দেড়টার দিকে মেডিকেল থেকে লিখে দেওয়া ওষুধ কিনতে গিয়ে তিনি নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। তার কাছে বাড়তি দাম তো রাখা হয়েছেই, উল্টো খারাপ ব্যবহারও করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ শুধু ফার্মেসি নয়, মেডিকেলের দেওয়ালেও যেন টাকা খুঁজে। আয়া, নার্স, আনসার—সব যেন টাকার পাগল। টাকা না দিলে দুর্ব্যবহার করে অনেক।’

নৈরাজ্য হাজারী গলিতেও

শুধু চমেকের আশপাশের ওষুধের দোকান নয়, নগরের হাজারি গলির অন্যান্য দোকানের বিরুদ্ধেও রয়েছে এমন অভিযোগ। ওষুধের গায়ে দাম না থাকার সুযোগে রোগীদের কাছ থেকে দাম বেশি রাখা হয়। শুধু তাই নয়, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে যে ওষুধের নাম লেখা থাকে তার বদলে অন্য কোম্পানির ওষুধও গছিয়ে দেওয়া হয়।

রোগীদের অভিযোগ, পুরো পাতা ওষুধ বিক্রি না করে তিনটা বা চারটা করে ওষুধ বিক্রির প্রবণতাও রয়েছে ফার্মেসিগুলোতে। এতে অনেক সময় ওষুধের মেয়াদ আছে কিনা—তাও বোঝা সম্ভব হয় না। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও বিক্রি করে দেন দোকানিরা। এতে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

সম্প্রতি হাজারি গলি থেকে ওষুধ কেনা মো. মিনহাজ নামে এক ছাত্র সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার বাবার হার্নিয়ার অপারেশন হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। আমি হাজারী গলির একটি ফার্মেসিতে যাই একটি ইনজেকশন কিনতে। মূলত ইনজেকশনের দাম ছিল মাত্র ১৫ টাকা। কিন্তু তখন আমার কাছে ফার্মেসী ওই ইনজেকশনের দাম ২৫০ টাকা রাখে। তারা এটাও বলেছে, ‘নিলে নেন, না নিলে নাই’। উপায় না পেয়ে আমি নিয়ে নিই বেশি দামেই।’

‘অসহায়’ ওষুধ প্রশাসন

দিনে অভিযান চালালে রাতে ফের একই কারবারে মেতে উঠে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার ফার্মেসিগুলো। নিয়মিত তদারকির পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও ক্রেতাদের অভিযোগেও নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। মোটা অঙ্কের জরিমানা, সতর্কবার্তা কিছুতেই তাদের দমানো যাচ্ছে না। দালালের দৌরাত্মে আরো লাগামহীন তাদের জোচ্চুরি। ক্রয় রশিদ না পাওয়ায় ক্রেতারা ‘নালিশ’ করতে পারছে না। আর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরও তাদের লাগাম টানতে পারছে না।

ওষুধের দাম এবং নৈরাজ্যের বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল এলাকার ফার্মেসিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে বিভাগীয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস. এম. সুলতানুল আরেফিন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমাদের রুটিন কাজের অংশ হিসেবে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। এছাড়া কেউ অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি। কিছুদিন আগেও ইমন মেডিকেল হল নামে ফার্মেসিতে অভিযান চালানো হয়েছে। তখনও জরিমানা করা হয়েছে।’

দালালদের উৎপাতের ফলেই এই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সমস্যা যেটি সেটি হলো, মেডিকেলের অনেক দালাল আছে। আর সেই দালালরাই ফার্মেসির ওদের সাথে যোগসাজশে ছাড়ের নামে বাড়তি দামে ওষুধ কিনিয়ে দেয়। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ওষুধ কেনার কোনো ইনভয়েস (চালান) না দেওয়ায় এটি প্রমাণ করা যায় না। তখন ক্রেতারা ভোক্তা অধিকারে যে অভিযোগ করবে বা আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো—কিন্তু বাড়তি দাম প্রমাণই করা যায় না। এটা অনেক পুরোনো অভিযোগ। আমরা দুইবার পূর্ব গেইটে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে এস. এম. সুলতানুল আরেফিন বলেন, ‘আমি অ্যাকশন নিচ্ছি। ওখানে অভিযান চালানো হবে। যতটুকু সম্ভব এই নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *