চট্টগ্রাম

বিলুপ্তির পথে শিকলবাহা খাল

কর্ণফুলীর শিকলবাহা চৌমুহনী, নয়াহাট এবং চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের উপর বয়ে যাওয়া শিকলবাহা খালটি দিন দিন হারিয়ে ফেলছে তার চিরচেনা স্বরূপ। খালের দু’পাশের কয়েক শতাধিক ডেইরি ফার্ম থেকে সৃষ্ট বর্জ্য মিশে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এই খাল। মাত্র এক থেকে দেড় দশকের ব্যবধানে খালের চিত্র পাল্টে দিয়েছে খালের পাশের কয়েক শতাধিক ডেইরি ফার্ম। প্রায় ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড খালটি পুনঃখনন করলেও দু’বছর না পেরোতেই মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের উদাসীনতা, ডেইরি ফার্ম মালিকদের অসচেতনতা কারণে মূলত শিকলবাহা খালটি এখন ‘মৃত্যু শয্যায়’ পৌঁছেছে- এমনটাই মনে করছেন স্থানীয়রা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, খালের পানি কৃষির সেচ কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে ২০২১ সালের জুনে প্রায় ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড খালটি পুনঃখননের উদ্যোগে নেয়। ২০২২ সালের জুনে খালটির পুনঃখনন কাজ শেষ হয়। তখন খালে পানির প্রবাহ সৃষ্টি হলেও দু’বছর না পেরোতেই ডেইরি বর্জ্যে মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে।

খালটি এখন কৃষকদের কোনো কাজেই আসছে না। তবে ডেইরি খামারদের দাবি, খালটি যথাযথভাবে খনন না হওয়ায় এবং মইজ্জারটেক সিডিএ আবাসিক এলাকায় জিলানী সিএনজি স্টেশন এবং বিদ্যুৎ বিভাগ খালের ওপর স্থাপনা করায় খালটির পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে ভরাট হয়ে গেছে। এসব স্থাপনার কারণে খালটি পুনঃখনন করার পরও কোন সুফল মেলেনি।

প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলীতে বর্তমানে ছোট বড় প্রায় ছয়শ ডেইরি ফার্ম রয়েছে। যার অধিকাংশ উপজেলার শিকলবাহা এবং চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন অংশে। এসব ফার্মে প্রায় ২৫ হাজার গরু রয়েছে। যেখান থেকে দৈনিক তিন হাজার টন গোবর ও দুই লাখ লিটারমূত্র উৎপন্ন হয়। এসব গোবর আর মূত্রের অধিকাংশ শিকলবাহা খালে মিশে খালকে করেছে দূষণ ও ভরাট। শত শত ডেইরি ফার্মের বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলার কারণে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে করতে এই খাল এখন ধ্বংসেরদ্বার প্রান্তে পৌঁছে গেছে। দেড় দশক আগে শুরু হওয়া এই দূষণ ইতিমধ্যে খালের পানির মান বা গুণাগুণকে সম্পূর্ণ নষ্ট করেছে।

গত বুধবার উপজেলার শিকলবাহা খাল এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ডেইরি ফার্মের মালিকরা গোবর ও মূত্র মিশ্রিত দূষিত পানি পাইপ ও ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি খালে ফেলছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বলা আছে। নামে খাল হলেও শিকলবাহা খালটি আদতে একটি নোংরা ডোবা এবং গোবরের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খালে অপসারিত বর্জ্য থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, যার ফলে খাল থেকে সবধরনের মাছ ইতিমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। খালের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় উৎকট গন্ধে গা গুলিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও সৃষ্টি হয় পথচারীদের।

৬০০ ডেইরি ফার্মে প্রতিদিন কয়েক টন গোবর ও মূত্র উৎপন্ন হয়। মাত্র ৫০টি মতো ফার্মে গোবর প্রক্রিয়াজাত এবং অপসারণ করা হয়। বাকি ফার্মগুলোতে বর্জ্য অপসারণের কোন ব্যবস্থা নেই। তাদের অধিকাংশই ড্রেন বা পাইপের মাধ্যমে সরাসরি খালে বর্জ্য ফেলে।

উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের শাহ ইসলামিয়া ডেইরি ফার্মের মালিক হাবিবুর রহমান স্বীকার করেন, তার খামারের বর্জ্য দিয়ে খালটি দূষিত হচ্ছে। একই কথা স্বীকার করেন আরেক ফার্ম মালিক মো. জসিম উদ্দীনও। হাবিবুর রহমান এবং জসিম উদ্দীনের দাবি, বর্জ্য পরিশোধনের কোনো বিকল্প না থাকার কারণে তিনি এবং তার মতো অন্যরা গোবর মিশ্রিত দূষিত পানি সরাসরি খালে ফেলতে বাধ্য হন। তবে সাধারণ মানুষের বক্তব্য হলো যারা ফার্ম পরিচালনা করে অর্থ উপার্জন করছে তাদেরই বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা করা উচিত।

নিয়ম-নীতির লঙ্ঘন করে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে কি করে ফার্ম মালিকরা খালে বর্জ্য ফেলছেন এর উত্তর জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে আমাদের জনবল না থাকার কারণে সব বিষয়ে নজর রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে ইতিপূর্বে আমরা খাল দূষণের পেছনে জড়িত কিছু ফার্ম মালিককে জরিমানা করেছিলাম।বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট ছাড়া যারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেসব প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।’ এরমধ্যে আবারও অব্যবস্থপনার খবর তাদের নজরে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা নিয়মনীতি অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট ছাড়া ফার্মগুলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে অনুমোদন না দেওয়ার কথা বললেও বুধবার বিকেলে শিকলবাহা এবং চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের ডেইরি ফার্মগুলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় কোন ধরনের বর্জ্য অপসারন ব্যবস্থাপনা বহির্ভূত ফার্মের বর্জ্য সরাসরি খালেই ফেলা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় মানুষের উদাসীনতা, ডেইরি ফার্ম মালিকদের অব্যবস্থাপনার জন্য শিকলবাহা খালের এই মৃতপ্রায় অবস্থা।’ স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, নিজস্ব জনবল ও কাঠামো থাকার পরেও কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন এই খাল রক্ষার দায়িত্ব পালন করছে না। তারা চাইলে ফার্ম মালিকদের ডেকে নিয়ে বর্জ্য অপসারণের সু-ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।’ এর আগে ২০২২ সালের ৯ মে এই খালকে দূষণমুক্ত করা ও ডেইরি ফার্ম থেকে সৃষ্ট বর্জ্য জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে একটি বিশেষ সভা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। করা হয় একটি কমিটিও। সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল.এ) মাসুদ কামাল। সভায় তৎকালীন কর্ণফুলীর ইউএনও শাহিনা সুলতানা ও বর্তমান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রুমন তালুকদার উপস্থিত ছিলেন। ছয় শ ডেইরি ফার্মের বর্জ্যে দূষিত ও ভরাট হওয়া শিকলবাহা খাল দূষণমুক্ত নানা পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তার আর বাস্তবায়ন হয়নি।

কর্ণফুলী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রুমন তালুকদার পূর্বকোণকে বলেন, ‘ডেইরি ফার্মের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আগেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটা সময় ফার্ম মালিকরা তাদের বর্জ্যগুলো খালে ফেললেও এখন তার সংখ্যা কমে এসেছে। পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের সচেতন করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *