কমে গেছে ঘুম, আক্রান্তরা ওষুধনির্ভর
ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস ছিল ১১ বছরের আয়মানের। পরিবার নিয়ে এসেছিল তাবিজ আর পানিপড়া। কিন্তু কাজ হয়নি। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানা গেল, এটি একটি অসুখ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগের নাম সোমনাম্বুলিজম।
চিকিৎসকদের মতে, সোমনাম্বুলিজম-এ যারা আক্রান্ত, ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর তারা আর এ বিষয়ে কিছুই মনে করতে পারে না। ফলে ঘুমের ঘোরে বিছানা ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা নিজের অজান্তেই পৌঁছে যায় অন্য ঘর কিংবা স্থানে। অনেক ক্ষেত্রে চোখ খোলা থাকলেও দৃষ্টি থাকে শূন্য। এই রোগে আক্রান্তকে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তরও দিতে পারে না। কেউ বারবার চোখ মুছে বা কাপড় ধরে টানাটানি করে। কেউবা ঘুমের মধ্যেই বিছানায় প্রস্রাব করে দেয়।
এমন রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, অনিয়মিত ঘুমের অভ্যাস, নিয়মিত ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি, প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও স্নায়ুর সমস্যা। কিছু ক্ষেত্রে এই রোগ বংশানুক্রমে দেখা যায়। যমজ সন্তানদের মধ্যেও এই সমস্যা দেখা যায়। বাবা অথবা মা যে কোনো একজন সোমনাম্বুলিস্ট হলে, ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সন্তান এ রোগে আক্রান্ত হয়। আর দুজনই হলে, সন্তানের সোমনাম্বুলিস্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৬০ শতাংশ। পলিসমনোগ্রাফির মতো পরীক্ষায় এই সমস্যা চিহ্নিত করা যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে এবং অ্যান্টিডিপ্রেশন ওষুধের সাহায্যে সোমনাম্বুলিজম থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ব্যস্ততম জীবনে ঘুমের জন্য সময় পাওয়া কঠিন। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক অনেকেই এখন অনিদ্রা, নিদ্রাকালীন শ্বাসরোগ যেমন: নাক ডাকা, অতিনিদ্রা, সোমনাম্বুলিজম রোগে ভুগছেন। এতে বাড়ছে ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হৃদরোগের ঝুঁকি। ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় অফিসে কাজে অমনোযোগীতা, সহকর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার ও মেজাজ খিটখিটে থাকছে।
চিকিৎসকদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে কমপক্ষে যদি ৬ ঘণ্টাও টানা ঘুম না হয়, তাহলে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা অনিদ্রায় ভুগছেন- তারা অন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যসঙ্কটেও ভুগছেন।
‘শার্প ওয়েভ রিপালস’ নামে পরিচিত মস্তিষ্কের একটি ক্রিয়া স্মৃতিকে একত্রিত করতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের নিওকর্টেক্স ও হিপ্পোক্যাম্পাসের সহায়তায় এই স্মৃতি স্থায়ী জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়। গভীর ঘুমের মধ্যে এই প্রক্রিয়াটি সবচেয়ে ভাল হয়। দেরি করে ঘুমোতে গেলে এই প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। ফলে ভুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা যায়।
শুধু শারীরিক সমস্যা থেকে বাঁচতে নয়, কাজে গতি বাড়াতে এবং শরীর চনমনে রাখতেও অত্যন্ত জরুরি ঘুম। ২০০৫ সালের এক সমীক্ষা বলছে, যারা উদ্বেগ বা মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, তাদের বেশিরভাগই গড়ে রাতে ছয় ঘণ্টার কম ঘুমান। অনিদ্রা আর মানসিক অবসাদ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
করোনাকালে অনেকের জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ে, সুস্থ থাকার চিন্তা বাড়ে। বাড়ি-ঘরে বেশিরভাগ সময় আবদ্ধ থাকার কারণে টেলিভিশন দেখা, শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন-কম্পিউটার ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে ঘুম কমেছে। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসকদের কাছে ঘুমের সমস্যা নিয়ে এসেছে বেশিরভাগ রোগী। এছাড়া কম ঘুমের কারণ হিসেবে রয়েছে- নেতিবাচক চিন্তা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, শারীরিক দুর্বলতা, শরীরে ব্যথা, সন্দেহপ্রবণতা, অ্যালকোহল ও ধূমপান ইত্যাদি।
অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশ এর মহাসচিব অধ্যাপক মনিলাল আইচ জানান, মানুষ ওষুধনির্ভর হয়ে পড়ছে। ঘুম সঠিক হলে রক্তচাপ থেকে রক্তে শর্করার মাত্রা, ওজন সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকে। বয়স বাড়তে থাকলে ঘুমের সময়ও কমতে থাকে। যাদের বয়স ৩০ থেকে ৪০ বা তার বেশি, তাদের ৭ ঘণ্টা ঘুমই আদর্শ।