সবাই যখন ব্যস্ত ভিডিওতে, চালককে বাঁচাতে তখন পুড়ছেন জাব্বার-আজিজ-ফরহাদরা
গত ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ এলাকায় মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশায় নিজ আসনে বসে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া চালকের হৃদয়বিদারক দৃশ্য নাড়া দিয়েছিল গোটা দেশ।
সেদিন যখন চালক আবদুস সবুর পুড়ে অঙ্গার হচ্ছিলেন, তখন আশাপাশে অনেকেই ছিলেন। কেউ ছিলেন ভিডিও করায় ব্যস্ত। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন কিভাবে পুড়ছে চালক সবুরের শরীর। এমন অবস্থায় সাহস করে চালকের জীবন বাঁচাতে নিজেদের জীবনবাজি রেখে এগিয়ে এসেছিলেন চারজন। চালক সবুরকে উদ্ধার করতে না পারলেও জ্বলন্ত সেই সিএনজি থেকে উদ্ধার করা হয় শিশু-নারীসহ তিন যাত্রীকে। অকুতোভয় সেই চার উদ্ধারকারীর তিনজন এখন কাতরাচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায়। বাকীজন আছেন স্থানীয় একটি ক্লিনিকে।
গতকাল চমেক হাসপাতালে কথা হয় তাদের তিনজনের সঙ্গে। তাদের একজন সিএনজি ট্যাক্সিচালক আব্দুল আজিজ। চমেক হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। তার পাশেই দগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব আব্দুল আজিজ ও যুবক ফরহাদ হোসেন বাবু। আব্দুল আজিজ চন্দনাইশের হাশিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। আর ট্রাকের হেলপার ফরহাদ হোসেন বাবু চন্দনাইশের কাঞ্চননগরের বাসিন্দা।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সিএনজিচালক আব্দুল আজিজ বলেন, ‘চলন্ত অবস্থায় একটি সিএনজি অটোরিকশা হঠাৎ মোড় ঘুরিয়ে নেয়। পেছন থেকে বালু বোঝাই একটি ট্রাক এসে সিএনজিকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে উল্টে যায় সিএনজি ট্যাক্সিটি। গাড়ি থামিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে দেখি ভেতরে একজন নারী ও শিশুসহ তিন যাত্রী আর্ত-চিৎকার করছেন। উদ্ধারে তখন দৌঁড়ে আসেন এক বৃদ্ধ ও ট্রাকের হেলপার।’
তিনি বলেন, ‘কোনরকম যাত্রীদের উদ্ধার করতে পারলেও গাড়ির নিচে পা আটকে যাওয়ায় এবং মাথায় আঘাপ্রাপ্ত হওয়ায় ট্যাক্সিচালককে উদ্ধার করা যাচ্ছিল না। পরে সবাই মিলে যখন উল্টে থাকা গাড়িটা দাঁড় করানো হয়, তখন আমি ট্যাক্সিচালককে ধরতে যাওয়া মাত্রই বিকট শব্দে আগুন ধরে যায়। ওই সময় পর্যন্তও চালককে টানাটানি করে বের করার চেষ্টা করা হলেও তাঁর বাম পা আটকে থাকায় আর বের করা সম্ভব হয়নি। শেষমেষ নিজেরাই নিজেদের রক্ষার জন্য দৌড়ে চলে আসি। আশপাশে এমনকি অদূরে পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও কেউই তখন এগিয়ে আসেনি। পরে শুনলাম ওই ট্যাক্সিচালক গাড়িতেই কয়লা হয়ে গেছে।’
দুর্ঘটনাস্থলের পাশেই খেতে সবজি তুলছিলেন ষাটোর্ধ্ব আব্দুল জাব্বার। চলন্ত গাড়ি উল্টো যাওয়ার দৃশ্য দেখে তিনি এগিয়ে যান। আগুনে তার শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় চমেক হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি।
আব্দুল জাব্বার বলেন, সবজি তুলছিলাম। ঘটনা যেখানে তার থেকে ২০/৩০ হাত দূরে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি ধরছিলো। তা দেখেই ওই সিএনজি চালক তার গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলে। ঘুরানোর মুহূর্তেই ট্যাক্সিটি উল্টে যায়। তখন ট্যাক্সির ভেতর থেকে যাত্রীরা চিৎকার শুরু করলে এগিয়ে যাই। যাত্রীরা কোনমতে বের হতে পারলেও চালকের পা আটকে যাওয়ায় তাকে বের করা যায়নি। তার আগেই গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। আগুনে আমরা চারজন পুড়ে যাই।
আক্ষেপ করে ষাটোর্ধ্ব আব্দুল জাব্বার ও উদ্ধারকারী ট্যাক্সিচালক আব্দুল আজিজ বলেন, অদূরেই পুলিশ সদস্য ও সাধারণ লোকজন থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। আমরাও যে আগুনে পুড়ছি, তাতেও এগিয়ে এল না। নিজের জান নিজেকেই বাঁচতে হলো। সবাই তখন ছবি তোলা ও ভিডিও করা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। মুহূর্তেই যদি আশপাশের মানুষ এগিয়ে আসতো তাহলে এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।’
এদিকে, ১৭ বছর বয়সী যুবক ফরহাদ হোসেন বাবুও সেদিন বড়দের সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন চালক সবুরকে উদ্ধার করতে। আগুনের লেলিহান শিখায় মুহূর্তেই তিনিও অগ্নিদগ্ধ হন। এখন মৃত্যুশয্যায় কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে। তার শরীরের ১৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। পুড়েছে শ্বাসনালীও।
কথা বলতে না পারায় শয্যার পাশে থাকা ফরহাদ হোসেনে মা ফাতেমা বেগম জানান, দিনমজুর বাবার আয় দিয়ে সংসার চলতে কষ্ট হয়। যে কারণে সংসার চালাতে ছোট ছেলে বাবু নিজেই গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ নিয়েছে। কিন্তু এখন সংসারের চেয়ে নিজের সন্তানের জীবন বাঁচানো নিয়েই শঙ্কায় পড়েছি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আগুনে আব্দুল জব্বার ও আজিজের শরীরে ১৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। আর ১৭ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফরহাদ হোসেনের।’
প্রসঙ্গতঃ গত ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ উপজেলায় একটি চলন্ত সিএনজি অটোরিকশায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর অগ্নিদগ্ধ হয়ে আবদুস সবুর নামে এক ট্যাক্সিচালক মারা যান। পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কায় বিস্ফোরণের পর আগুন লাগলে ওই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। এতে ওই গাড়িতে থাকা তিনযাত্রী জীবন নিয়ে বের হতে পারলেও ভেতরেই পুড়ে অঙ্গার হন চালক।