কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম
১৯২৬ সালের জুলাই মাসে প্রথম চট্টগ্রামে এসেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের নেতা কবির বন্ধু হাবিবুল্লাহর বাহারের দাওয়াত এবং কলেজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
আন্দরকিল্লায় শাহী জামে মসজিদে এক সভায়ও যোগ দেন কবি নজরুল। অনুষ্ঠানে তাঁকে ‘কবি সম্রাট’ উপাধি দেওয়া হয়।
পাঠ করা হয় একটি ঘোষণাপত্র- ‘এই সভা ঘোষণা করিতেছে যে, কবি নজরুল ইসলাম বাংলার মুসলমান সমাজের রত্নস্বরূপ’।
কলকাতা থেকে এসে কবি জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলোতে ওঠেন। হাবিবুল্লাহ বাহার ও তার বোন শামসুননাহার মাহামুদ কবিকে তাঁদের বাসায় নিয়ে যান। চট্টগ্রাম কলেজে কবি’র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন। এরপর সীতাকুণ্ডে ও জেএম সেন স্কুলে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওইসময় কবি আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ, মুসলিম হল, সীতাকুণ্ড পাহাড় সহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন।
প্রথমবার চট্টগ্রাম এসে খুব খুশি হয়েছিলেন কবি নজরুল। বেগম শামসুননাহারের কাছে তিনি চিঠি লিখেছিলেন- ‘ফুল যদি কোথাও ফুটে, আলো যদি কোথাও হাসে, সেখানে আমার গান গাওয়ার শোভা পায়, গান গাই। সেই আলো, সেই ফুল পেয়েছিলাম এবার চট্টলায়, তাই গেয়েছি গান। কবিকে খুশী করতে হলে দিতে হয় অমূল্য ফুলের সওগাত’।
১৯২৯ সালে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ২য় বার চট্টগ্রামে এসেছিলেন কবি। ‘চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সভাপতি হিসেবে কবি ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণটি ছিল শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর মুসলিম সমাজকে উদ্দেশ্য করে। এছাড়া কাট্টলী চৌধুরী পরিবারে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় মুসলিম লীগ নেতা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী ও মৌলভী তমিজুর রহমানের উদ্যোগে। কাট্টলীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবিকে ‘তরুণ মুসলিম নেতা’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
বুলবুল সমিতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবি নজরুলকে ‘বাংলার শেলি’ উপাধি দেওয়া হয়। পরে চট্টগ্রামবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কবি বলেছিলেন, ‘কোনোদিন তোমাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারব এ ঔদ্ধত্য আমার নেই, সম্বলও নেই। আমি যাযাবর কবি-আমায় ঝুলি ভরে যে পাথেয় দিলে তোমরা, তাই যেন আমার ভাবী পথের সহায় হয়। বিনিময়ে আমি রেখে গেলাম তোমাদের সিন্ধুতে তোমাদের কর্ণফুলীতে আমার দুই বিন্দু অশ্রু। তোমাদের হাতের দানকে চোখের জলে ভিজিয়ে গেলাম’।
ওইসময় কবি পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, ফতেয়াবাদের আলম পরিবারে, সন্দ্বীপে মোজাফফর আহমদের বাড়ি ও শহরের তামাকুমণ্ডি লেনের হাবিবুল্লাহ বাহারের বাসভবন আজীজ মঞ্জিলে বেড়াতে গেছেন। শহরের নন্দনকানন ডিসি হিলে বসে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন কবিতা- বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি।
‘বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী!
ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হয়ে এল বিদায়ের রাতি!
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি,
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি’।
১৯৩৩ সালে ৩য় বার চট্টগ্রাম আসেন কবি নজরুল ইসলাম। রাউজানে তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনীতে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় গরু-ছাগল জবাই করে মেজবান খাওয়ানো হয়। টিকিট কেটে কবিকে দর্শন করেছিলেন উৎসুক জনতা।
রাউজান জলিলনগর বাসস্ট্যান্ড হতে আধা কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে হাজী বাড়ি। এই হাজী বাড়িতে ১৯৩৩ সালের ৫ ও ৬ মে এই দুইদিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের জন্য হাজীবাড়ির উত্তর পাশে ধানি জমির মাঠে রায়মুকুট দীঘির পূর্বপাড়ে বিশাল প্যান্ডেল করা হয় বাঁশের খুঁটি, ছনের ছাউনি দিয়ে। প্যান্ডেল তৈরিতে সময় লেগেছিল একমাস। রাউজানবাসী কবি নজরুলকে ‘কাজী দা’ নামে ডাকতেন। ৫ মে সকালে নৌকায় করে হালদা নদী পার হয়ে রাউজানে এলে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে কবিকে হাজী বাড়ি নিয়ে আসা হয়। কবি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন হারমোনিয়াম ও বাঁশি। পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি, সাদা গান্ধী টুপি ও জুতা।
প্রথম দিন আলোচনা শেষে বিকাল ৪টার পর কবি তাঁর কবিতা আবৃত্তি করেন। এরপর গেয়েছেন ইসলামিক গান। দ্বিতীয় দিন প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেওয়ার পর কবি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়েছিলেন-‘বাজল কিরে ভোরের সানাই/নিদমহলের আঁধার পুরে। শুনছি আজান গগনতলে/অতীত রাতের মিনার চুড়ে’। ৭ মে গহিরাবাসী গহিরা স্কুলে তাঁকে তাৎক্ষণিক সংবর্ধনা দেয়। সেখানে ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’সহ বেশ কয়েকটি গান গেয়ে শোনান কবি। সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হাজী বাড়ির সামনে স্থাপিত হয়েছে নজরুল স্মৃতিফলক।
১৯৭৩ সালে ৪র্থ বারের মতো ৭৫ বছর বয়সে একদিনের জন্য কবি এসেছিলেন চট্টগ্রামে। তখন তিনি ছিলেন অসুস্থ, হারিয়েছেন বাক ও স্মৃতিশক্তি। পরদিন তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
কবি নজরুলের ‘সিন্ধু’, ‘বাংলার আজিজ’ ‘কর্ণফুলী’ কাব্যে এবং ‘সিন্ধু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে চট্টগ্রাম সফরের কথা উল্লেখ রয়েছে। চট্টগ্রামে এসে কবি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সম্মানের গান’। সন্দ্বীপ নিয়ে লিখেছিলেন গীতিনাট্য ‘মধুমালা’। এছাড়া লিখেছেন- চক্রবাক, শীতের সিন্ধু, শিশু যাদুকর, সাত ভাই চম্পার বেশ কিছু কবিতা, আমার সাম্পান যাত্রী লয়, ওরে মাঝি ভাই তুই কি দুঃখ পেয়ে কুল হারালি অকুল দরিয়ায়, তোমায় কুলে তুলে বন্ধু আমি নামলাম জলে, পর জনমে দেখা হবে প্রিয়া ইত্যাদি কবিতা ও গান।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের পৌত্রী বেগম খিলখিল কাজী বলেন, ‘এই চট্টগ্রাম দাদুর স্মৃতিতে ভরা। চট্টগ্রামে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র হবে বলে শুনেছি। এটা হলে চট্টগ্রামের মানুষের জন্য আনন্দের বিষয় হবে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম কবি নজরুলকে জানতে পারবে’।