রাজনীতি

১৪ দলীয় জোট শুধু নামে, অনিশ্চয়তায় শরিকেরা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিকদের দূরত্ব বেড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ‘জোট আছে’ এই কথা জোর দিয়ে বলতে পারছে না শরিকেরা। এখন জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচি অনেকটা ‘নিয়ম রক্ষার’ কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের শরিকদের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এই তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জোট ভেঙে দেওয়া কিংবা বিচ্ছিন্ন হওয়ার দায় নেবে না আওয়ামী লীগ; শুধু নামেই পাশে রাখতে চায় জোটের শরিকদের। অন্যদিকে শরিকদের জোট ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার মতো রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা সাহস নেই। তাদের সবাই আগামীর রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরই জোটের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়েছে।

২৩ মে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে জোটের শরিকেরা সরাসরি ১৪ দলের প্রাসঙ্গিকতা আছে কি না, তা জানতে চেয়েছে। জবাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রাসঙ্গিকতা আছে বলেই বৈঠক ডাকা হয়েছে। তবে তাদের এটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে শরিকেরা দল হিসেবে দুর্বলই রয়ে গেছে; নিজেদের শক্তি বাড়াতে হবে। এতে শরিকেরা জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

জোটের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শরিক দলের দায়িত্বশীল একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৪ সালে ১৪ দল গঠনের সময় বলা হয়েছিল আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন সবকিছু একসঙ্গে হবে। ২০১৮ সাল থেকে আর জোটের সরকার নেই। পুরোপুরি আওয়ামী লীগের সরকার হয়ে গেছে। রাজপথের কর্মসূচিও নেই। মাঝেমধে৵ কেন্দ্রীয়ভাবে কিছু বৈঠকে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে জোটের কার্যক্রম। কোথাও ১৪ দলের কোনো অস্তিত্ব নেই।

ওই নেতা আরও বলেন, একসঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেওয়া হচ্ছে। তবে দিন দিন জোটের শরিকদের হিস্যা কমছে। বর্তমান সংসদে জোটের সরাসরি প্রতিনিধি মাত্র দুজন। ফলে জোট থাকা না থাকার মধ্যে খুব পার্থক্য নেই।

ভোট সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ভাবনা
ক্ষমতাসীন জোটের সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ ও সরকার তাদের মিত্র হিসেবে প্রগতিশীল কিছু দল ও তাদের নেতাদের পাশে রাখতে চায়। এ জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও জাতীয় নির্বাচনে শরিকদের কিছু আসনে ছাড় দিতে হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না কোথাও। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র ও তৃণমূলের নেতাদের একটা বড় অংশ এখন আর এই ছাড় দিতেও রাজি নয়। এমনকি নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও এমন ধারণা যে ১৪ দলের শরিকদের সেই অর্থে ভোট নেই। ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ কেউ জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব কথা প্রকাশ্যেও বলেছেন। এ পরিস্থিতিতে শুধু নামে জোট রাখার কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

এই কৌশলের বাস্তবায়ন ছিল গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া শুরুর পর থেকে গত নির্বাচনেই সবচেয়ে কম, ছয়টি আসন শরিকদের দেয় আওয়ামী লীগ। সমঝোতার মাধ্যমে ছাড় দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী দেয়নি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেয়। শরিকদের বারবার অনুরোধের পরও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট থেকে সরায়নি আওয়ামী লীগ। ফলে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় নেতা এ কে এম রেজাউল করিম ছাড়া কেউ জিততে পারেননি। এমনকি শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যাঁরা টানা তিনবার কিংবা এরও বেশি সংসদ সদস্য ছিলেন, তাঁরাও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান। এর ফলে জোটে দূরত্ব বাড়ে।

১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু প্রথম আলোকে বলেন, শরিকদের নিয়ে আরও বসতে হবে। শিগগিরই তিনি বৈঠক করবেন। এরপর পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে।

জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে সোচ্চার হবে শরিকেরা
১৪ দলের শরিকেরা মনে করছে, আওয়ামী লীগ এবং সরকার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে না পড়লে ১৪ দলের শরিকদের পাত্তা দিতে চায় না। এ জন্য নিজেরা সরকার ও আওয়ামী লীগকে চাপে রাখার চিন্তা করছে কিছু শরিক দল। এ লক্ষ্যে ‘জনসম্পৃক্ত’ ইস্যুতে নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি নেওয়ার চেষ্টা করছে শরিকেরা।

এ ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদেশে অর্থ পাচার, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার—এসব বিষয়ে কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে শরিকেরা।

শরিক দলগুলোর সূত্র বলছে, আগামী বাজেট ঘোষণার পর কর্মসূচি আসবে। ঈদুল আজহার পর রাজপথের কর্মসূচি পালন শুরু করবে তারা।

১৪-দলীয় জোটের শরিকদের সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককে জোটের জন্য অনেকটা ‘ভাগ্য নির্ধারণী’ বৈঠক হিসেবে বিবেচনা করেছিল শরিকেরা। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে শরিক দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন।

ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া একটি শরিক দলের দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠক থেকে বলার মতো বড় কোনো অর্জন দেখেন না তিনি।

১৪ দলের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর আশা জোটগতভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাড়বে। তবে তা না হলেও সমস্যা নেই। তাঁর দল জাসদ ঈদুল আজহার পর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি ও অর্থপাচারসহ নানা বিষয়ে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে।

২০১৮ সাল থেকেই অস্তিত্ব–সংকটে
২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ৪–দলীয় জোটের কাছে বড় পরাজয় ঘটে এবং ক্ষমতা হারায় আওয়ামী লীগ। তখন অনেকটাই চাপে পড়েছিল দলটি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা হয়। এরপরই মূলত ১৪ দলের জন্ম।

২০০৫ সালের ১৫ জুলাই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ২৩ দফা লক্ষ্য ও কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ, ১১–দলীয় জোট, জাসদ ও ন্যাপকে (মোজাফফর) নিয়ে ১৪–দলীয় জোটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

শুরুতে জোটগতভাবে অনেক সভা-সমাবেশ করা হয়। এক-এগারোর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংস্কার ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে ১৪ দল লাগাতার হরতাল ও অবরোধসহ নানা কর্মসূচি ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করে। প্রতিটি দলের গুরুত্ব বোঝাতে তখন প্রস্তুতিমূলক বৈঠকগুলো একেক দিন একেক শরিকের কার্যালয়ে হতো। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিসহ মহাজোট নামে নির্বাচনে অংশ নেয় ১৪ দল। ওই নির্বাচনে জোটের শরিক জাসদ তিনটি ও ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি আসনে জয়ী হয়। টেকনোক্র্যাট কোটায় জোটের নেতা দিলীপ বড়ুয়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তরীকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি) জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই নির্বাচনে সংরক্ষিত দুজনসহ ১৩ জন সংসদ সদস্য পান ১৪ দলের শরিকেরা। রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে শরিকদের আটজন সংসদ সদস্য হন। সংরক্ষিত নারী আসন ছিল দুটি। কিন্তু শরিক দলের কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি।

সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসনে ছাড় পায় ১৪ দলের শরিকেরা। এর মধ্যে মাত্র দুটি আসনে জয় পায়। মন্ত্রিসভায়ও স্থান হয়নি।

শরিক দলগুলোর সূত্র বলছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত জোটে একধরনের সক্রিয়তা ছিল। এরপর থেকেই ক্রমে দূরত্ব তৈরি হয় জোটে।

জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘাটতি, সাংগঠনিক আচরণসহ সব বিষয়ে তারা প্রধান দলকে অবহিত করেছেন। বাকিটা কী হবে, তা সময় বলে দেবে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন দলে ফিরে যাব। সবার কথা শুনছি। নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *