নারী-পুরুষের নামাজের পার্থক্য
নারী ও পুরুষ আল্লাহর সৃষ্টির দুই অংশ। সৌন্দর্যের দুই সংজ্ঞা। বিপরীতমুখী দুই চরিত্রের একত্রে মিলেমিশে বসবাস করার এক অনুপম নজির। শুধু বাহ্যিক সৃষ্টির দিক দিয়ে নয়, এ দুইয়ের মাঝে রয়েছে আচরণ ও চলাফেরার দিক থেকেও নানা ব্যবধান।
তাই তারতম্য তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মাসয়ালার ক্ষেত্রেও। যেমন- নারীর পর্দা নিজেকে আবরণে, অপরদিকে পুরুষের পর্দা দৃষ্টির হেফাজতে।
উচ্চস্বরে আজান দেবে পুরুষ, নারী হেফাজত করবে নিজ কণ্ঠ। এমনই দশদিকের মতো নারীদের নামাজের পদ্ধতিতেও রয়েছে ভিন্নতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো একই, তবে তাদের পর্দা ও আড়ালে থাকার বিবেচনায় সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। এখানে নামাজের পার্থক্যগুলো উল্লেখ করা হলো-
১. তাকবিরে তাহরিমার সময় নারীরা হাত তুলবে বুক বরাবর। বিপরীতে পুরুষরা হাত তুলবে কান বরাবর। হজরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হলাম, তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সঙ্গে একথাও) বললেন, হে ওয়াইল ইবনে হুজর! যখন তুমি নামাজ শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর। -আল মুজামুল কাবির, তাবারানি: ২২/২৭২
২. সেজদার সময় নারীরা এক অঙ্গের সঙ্গে অপর অঙ্গ মিলিয়ে কোমর নিচু করে জড়সড় হয়ে থাকবে। বিপরীতে পুরুষরা কোমর উঁচু করে রাখবে, এক অঙ্গ থেকে অপর অঙ্গ ফাঁক করে রাখবে।
তাবেয়ি ইয়াযিদ ইবনে আবি হাবিব (রহ.) বলেন, একবার রাসূল (সা.) নামাজরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদের বললেন, যখন সিজদা করবে তখন শরীর জমিনের সঙ্গে মিলিয়ে দেবে। কেননা মহিলারা এক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়। -কিতাবুল মারাসিল, ইমাম আবু দাউদ: ৮০
৩. বসার সময় নারীরা পুরুষদের মতো পায়ের ওপর বসবে না। বরং দু’পা ডান দিকে বের করে দিয়ে সরাসরি মাটির ওপর বসবে। বিপরীতে পুরুষরা বাম পা নিচে রেখে তার ওপর বসবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নারীরা যখন নামাজের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সঙ্গে মিলিয়ে রাখে; যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহতায়ালা তাকে দেখে (ফেরেশতাদের সম্বোধন করে) বলেন, ওহে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থাকো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। -সুনানে কুবরা, বায়হাকি: ২/২২৩
একবার হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, মহিলারা কীভাবে নামাজ আদায় করবে? তিনি বললেন, খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গ মিলিয়ে নামাজ আদায় করবে। -আল মুসান্নাফ, ইবনে আবি শায়বা: ১/৩০২
এভাবে নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত হাদিসে নারী-পুরুষের নামাজের পার্থক্য নির্ণয়ে মৌলিক নীতিমালাসমূহ বলে দেওয়া হয়েছে। এসব নীতিমালার আলোকে নারীদের নামাজে আরও কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন- নারীরা নামাজে উভয় পা মিলিয়ে দাঁড়াবে, ফাঁকা রাখবে না। তাকবিরে তাহরিমার সময় দু’হাত ওড়নার ভেতরে রাখবে, ওড়নার বাইরে হাত বের করবে না। সামান্য ঝুঁকে রুকু করবে, পিঠ টানটান করবে না। রুকু ও সেজদায় হাত-পায়ের আঙুলগুলো মিলিয়ে রাখবে।
অনেকে নারী-পুরুষের নামাজের এ সব ব্যবধানকে স্বীকার করেন না। তারা বোখারি শরিফের ৬০০৮ নম্বর হাদিস (তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছো সেভাবে নামাজ পড়ো)-কে সামনে রেখে বলেন, এ হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষ ও মহিলার মাঝে কোনো পার্থক্য করেননি। কাজেই উভয়ের নামাজের পদ্ধতি একই হবে। আসলে তাদের এ কথা যথার্থ নয়।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু সোলাইমান মালিক ইবনু হুয়াইরিস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমরা সমবয়স্ক কয়েকজন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। আমরা প্রায় বিশ দিন তার কাছে ছিলাম। তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা আমাদের পরিবারের নিকট ফেরার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। যাদের আমরা বাড়িতে রেখে এসেছি, তিনি তাদের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। আমরা তাকে জানালাম। তিনি ছিলেন দয়ার্দ্র ও কোমল হৃদয়ের। তাই তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাও। তাদেরকে (কোরআন) শিক্ষা দাও, সৎ কাজের আদেশ করো। আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছো, সেভাবে নামাজ পড়ো। নামাজের ওয়াক্ত হলে তোমাদের একজন আজান দেবে এবং যে তোমাদের মধ্যে বড় সে ইমামতি করবে।
এ হাদিসে দু’টি বিষয় লক্ষণীয়-
১. উপস্থিত যাদের উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) ওই নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের সবাই ছিলেন যুবক। তাদের মধ্যে কোনো নারী ছিল না। কথা তো উপস্থিতদের প্রতি লক্ষ্য করেই বলা হয়। অনুপস্থিতদের নয়। কাজেই এখানে ‘তোমরা’ সম্বোধন দ্বারা নারীকেও উদ্দেশ্য নেওয়া স্বাভাবিক রীতি বিরুদ্ধ কাজ।
২. হাদিসে নামাজের ব্যাপারে তিনটি আদেশ এসেছে। প্রথমত: আমার মতো নামাজ পড়ো, দ্বিতীয়ত: ওয়াক্ত হলে আজান দাও, তৃতীয়ত: বড়জন ইমামতি করবে।
একই বাক্যের তিনটি আদেশের প্রথম আদেশে যদি পুরুষের সঙ্গে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত থাকে তাহলে পরবর্তী দু’টি আদেশে নারীরা পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অর্থাৎ নারীরা আজান দিতে পারবে, নারীরা ইমামতি করতে পারবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো- যারা নারী-পুরুষের এক রকম নামাজের কথা বলেন, তারা কিন্তু নারীদের আজান ও ইমামতিকে সমর্থন করেন না। হাদিসের এক অংশকে মানা ও অপর অংশকে না মানার কোনো দলিল তাদের কাছে আছে কি?
ওপরের আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, নারী অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই নামাজের ক্ষেত্রেও পুরুষদের থেকে ভিন্ন, স্বতন্ত্র কিছু আদেশে আদিষ্ট। কাজেই, প্রত্যেক নারীরই সে আদেশ পালনে সচেষ্ট থাকা উচিত।