যোগাযোগ ব্যবস্থায় বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের দুর্ঘটনা কালো অধ্যায়: আদালতের পর্যবেক্ষণ
নগরের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্যে ৩টি গার্ডার ধসে পড়ে ১৩ জন মানুষ মারা যাওয়া ও বহু আহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।
বুধবার (১০ জুলাই) দুপুরে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডারধস মামলায় রায় ঘোষণা হয়।
রায়ে চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালত এই পর্যবেক্ষণ দেয়।
কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে আদালত বলেছে, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়ে মানুষের মৃত্যু ও আহতের ঘটনা ফৌজদারি মামলার মতো ঘটনা প্রমাণের কোনো আবশ্যকতা নেই।
ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাবে প্রমাণিত। এতো বিশাল আকারের কর্মযজ্ঞের মধ্যে ৩টি গার্ডার ভেঙে পড়ে বহু মানুষ মারা যাওয়া ও আহত হওয়ার এই ঘটনা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। মামলায় নিহতের ক্ষেত্রে আসামিদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মৃত্যু হতে পারে এমন ধারণাও আসামিদের ছিল না।
‘প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য, তদন্ত কমিটিসমূহের প্রতিবেদন ও নখিতে রক্ষিত কাগজাত দৃষ্টে, এতো বড় দুর্ঘটনায় সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের দায় প্রায় পুরোটাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার-পারিশো যৌথ কাজ। কিন্তু প্রতিষ্ঠান একটি বিমূর্ত ধারণা মাত্র, প্রতিষ্ঠানকে সাজা প্রদান করা বাস্তবসম্মত নয়। বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত এই দুর্ঘটনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মালিক থেকে শুরু করে সকল কর্মচারী, যারা যেই পদেই থাকুক না কেন। এই আসামিগণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে, প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংঘটিত যে কোনো অপরাধমূলক অবহেলার জন্য দায়ী। এই দায় আসামির ব্যক্তিগত নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক দায়। প্রতিষ্ঠানের দায়ের সাজা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের সাজা ভোগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বচ্ছতা ও জন্যবদিহিতা হুমকির মুখে পড়বে, একইসঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার এই নিম্ন বিত্ত মানুষগুলির পারিবারের অভিশাপ থেকে এ দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের জবাবদিহিতার অভাব, নির্মাণকারী, ঠিকাদার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে কাজের সমন্বয় না থাকা, ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো এতো বিশাল কর্মযজ্ঞে ন্যূনতম নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, দুর্ঘটনার পর ফ্লাইওভার নির্মাণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের পারস্পরিক দোষারোপ ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরির পাশাপাশি উদ্ভুদ্ধ যে যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃতদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত শ্রেণির এবং এদের অনেকেই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়। ২টি তদন্ত কমিটি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার ও পারিশার (জেভি) ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে বহু অনিয়ম ও ব্যত্যয় খুঁজে পেয়েছেন, যার দায় আসামিরা উক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে কোনোবেই এড়াতে পারেন না।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওমর ফুয়াদ বলেন, পেনাল কোডের ৩০৪ এর এ ৩৪ ধারায় অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামি ৮ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড ও অনাদায়ে আরও ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পেনাল কোডের ৩৩৮ এর ৩৪ ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। উভয় কারাদণ্ড একটির পর আরেকটি চলবে। রায়ের সময় আসামিরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, আসামিদের প্রত্যেককে ৩ লাখ টাকা জরিমানার টাকা নিহত পরিবারের কাছে ১ লাখ টাকা এবং আহতদের পরিবারকে অবশিষ্ট টাকা আনুপাতিক হারে প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আসামিদের উপর আরোপিত জরিমানার অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য করা হবে। সেইসঙ্গে আসামিদের উপর আরোপিত জরিমানার অর্থ এজাহারে উল্লেখিত নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারসমূহের নিকট রায়ে উল্লেখিত হারে হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।