স্বর্ণপদকের নামে ক্রেস্ট, বাঁশখালীতে বেগম রোকেয়ার নামে প্রতারণার ফাঁদ
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের তাত্ত্বিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শিক নেত্রী বেগম রোকেয়ার নামে বাঁশখালীতে ১৪ বছর ধরে বৃত্তি পরীক্ষা আয়োজন করা হলেও তাঁর পরিবারের কেউ এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। এমনকি ‘স্বর্ণপদক’ দেওয়ার কথা বলে পরীক্ষায় কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পুরস্কার হিসেবে ‘ক্রেস্ট’ দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে এমন প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে জহির উদ্দিন মজুমদার নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
জানা যায়, শনিবার (৩ আগস্ট) বাঁশখালীর চাম্বলের একটি কমিউনিটি সেন্টারে ‘বেগম রোকেয়া স্বর্ণপদক বৃত্তি পরীক্ষার’ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও বাঁশখালী থানার ওসিসহ জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ অংশ নেবেন উল্লেখ করে ব্যানার ও আমন্ত্রণপত্র করা হয়েছে।
জহির উদ্দিন মজুমদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ‘স্বর্ণপদক’ দেওয়ার কথা বললেও ‘ক্রেস্ট’ দিয়ে প্রতারণা করেন। তিনি প্রতি বছর বেগম রোকেয়ার নাম ও ছবি ব্যবহার করে বৃত্তি পরীক্ষা, গুণীজন সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের বৈধতা দিতে তিনি জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানান। সমাজের ধনী ব্যক্তিদের টার্গেট করে তিনি ‘পদক’ দেওয়ার নামে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। অথচ বেগম রোকেয়া পরিবারের কারও অনুমতি না নিয়েই তিনি তাঁর নামে এই আয়োজন করে আসছেন। জহির উদ্দিন মজুমদার বাঁশখালীর কাথরিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং গুনাগরী বড় বাজার শপিং মলের মালিক।
‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইন বৃত্তি পরীক্ষা-২০২৩’-এ পূর্ব বড়ঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র জাওয়াদ জারিফ চৌধুরী কৃতকার্য হয়েছেন। জাওয়াদ জানান, ফরম বিতরণের সময় তাদেরকে স্বর্ণপদক দেওয়ার কথা বলা হলেও এখন শোনা যাচ্ছে ক্রেস্ট দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ‘এত কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে ক্রেস্ট পেয়ে লাভ কী? এভাবে প্রতারিত হলে আমাদের উৎসাহ কমে যাবে।’
বাঁশখালী সরকারি বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী অর্মিতা বড়ুয়া ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইন বৃত্তি পরীক্ষা-২০২৩’-এ অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। পুরস্কার পাওয়াটা বড় কথা নয়, অংশগ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করাটাই বড়। কিন্তু কথায় গরমিল হলে খুব খারাপ লাগে। এই পুরস্কার আমি নিতে চাই না।’
অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ক্যাটাগরিতে কয়েকজনকে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে পেকুয়ার এক ব্যক্তিকে সাংবাদিক হিসেবে লেখা হলেও বাস্তবে তিনি মাদক কারবারি বলে অভিযোগ আছে। তাছাড়া বাঁশখালীর একজনের নাম সংবর্ধিতদের তালিকায় রাখা হলেও ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে প্রেসক্লাবের নামে বরাদ্দ আত্মসাত; এমনকি প্রেসক্লাবের চেয়ার টেবিল বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
চেয়ারম্যান হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে বাঁশখালীর এক বিতর্কিত ইউপি চেয়ারম্যানকে। যার বিরুদ্ধে বন বিভাগের গাছ কেটে সাবাড় করার অভিযোগ আছে। এমনকি বন বিভাগের লোকজন বাদী হয়ে তাকে আসামি করে মামলাও দায়ের করেছেন। এছাড়া দুদকের মামলায় সম্পদ জব্দের আদেশ হওয়া একজন বিতর্কিত ইউপি চেয়ারম্যানকে করা হয়েছে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জহির উদ্দিন মজুমদার ‘স্বর্ণপদকে’ স্বর্ণ না দেওয়ার কথা স্বীকার করেন; তিনি বলেন, ‘বাঁশখালীতে বিভিন্ন সময় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট বলা হলেও সেখানেও স্বর্ণ বা গোল্ড দেওয়া হয় না।’
জহির বলেন, ‘আমি বেগম রোকেয়ার পরিবারের মৌখিক অনুমতি নিয়েছি।’ বেগম রোকেয়ার পরিবারের কোন সদস্যের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দিদারুল আলম চৌধুরী নামের এক সদস্যের কাছ থেকে মৌখিকভাবে অনুমতি নিয়েছি আজ থেকে ১৪ বছর আগে।’
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইনের জন্ম রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নে। পায়রাবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফারুক হোসেনের সহযোগিতায় বেগম রোকেয়ার ভাতিজি মাজেদা ছাবেরের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই লন্ডন ও কলকাতায় থাকেন। শুধু আমি ঢাকায় থাকি। গ্রামের সাথে আমার যোগাযোগ কম। ২০ বছর আগে গ্রামে গিয়েছিলাম। কেউ বৃত্তি পরীক্ষা চালুর জন্য আমার সাথে যোগাযোগ করেননি। আমাদের পরিবারে দিদারুল আলম চৌধুরী নামে কেউ নেই। আমরা চৌধুরী বংশেরও নই।’
অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছে জলদি আধুনিক হাসপাতালের পরিচালক এসএম শোয়াইবুর রহমানকে। তবে উক্ত অনুষ্ঠান ও আয়োজনের সাথে তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন তিনি। তার হোয়াটসঅ্যাপে ব্যানার পাঠানো হলেও তিনি উক্ত অনুষ্ঠানে যাবেন না বলে মন্তব্য করেন।
বাঁশখালী থানার ওসি তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘এই ধরনের কোন অনুষ্ঠানের জন্য কেউ পুলিশের অনুমতি নেননি। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাঁশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমাকে অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক হিসেবে দাওয়াত করেছে। সেখানে সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা সাংবাদিক জনপ্রতিনিধিসহ সবাই থাকবেন বলেছে। আমি এর বেশি কিছু জানি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমিন আক্তার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কারফিউ’র মধ্যে আইনশৃঙ্খলার বিষয় জড়িত থাকায় আমি অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলেছি। আমি কালকে না যাওয়ার কথাও জানিয়ে দিয়েছি। বেগম রোকেয়ার পরিবারের অনুমোদন ও স্বর্ণপদক দেওয়ার নামে প্রতারণার বিষয়টি আমার জানা নেই।’