যে কারণে জৌলুস হারাচ্ছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের খাতুনগঞ্জ
খাতুনগঞ্জের যাত্রা শুরু হয়েছিল হামিদুল্লা মিয়ার বাজার থেকে। আবদুল হক চৌধুরী ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৮৫০ সালের দিকে) চট্টগ্রামের ইতিহাসপ্রণেতা ও ইংরেজ কর্মচারী খান বাহাদুর শেখ মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ খান (১৮০৯-১৮৮০) এই বাজার স্থাপন করেন। এই বাজারের পাশে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী খাতুন বিবির নিজস্ব জমিতে দোকানপাট গড়ে উঠতে থাকে। খাতুন বিবির নামে তা খাতুনগঞ্জ নামে পরিচিতি পায়।
ত্রয়োদশ শতকে আরব বণিকরা ভারতবর্ষে আসেন কর্ণফুলী নদী দিয়ে। পরে পর্তুগিজ, ফরাসি ও ব্রিটিশরাও নদীপথে আসেন। সপ্তম শতাব্দী থেকে দূরপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের আরব বণিকরা কর্ণফুলী নদী বিধৌত এ ব্যবসাকেন্দ্রে সওদা করতেন। কালক্রমে বিশ্বের বৃহৎ নদ-নদীর তীরে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক নগরীর মতো এ কর্ণফুলীর তীরে খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, চাক্তাই, বক্সির হাট, টেরিবাজার নিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে ওঠে। নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজারে রূপ নেয়। এ বৃহৎ বাণিজ্যিক এলাকাটি বাংলাদেশের অনেক সওদাগর, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতির সূতিকাগার।
ইংরেজ আমলের মতো পাকিস্তান আমলেও খাতুনগঞ্জ ছিল এ অঞ্চলের পণ্য বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে পণ্য বেচাকেনা হতো খাতুনগঞ্জ থেকেই। সে সময় অবাঙালিদের হাতে ছিল বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ। বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের আমদানি পণ্যের বিক্রেতা।
সে সময় ব্যবসায়ীরা দুভাগে বিভক্ত ছিলেন। বাঙালি ও অবাঙালি। বাঙালি ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই ছিলেন চট্টগ্রামের লোক। তারা পরিচিত ছিলেন চাটগাঁইয়া হিসেবে। অবাঙালিরা ছিলেন বোম্বাই ও গুজরাটের বাসিন্দা। অবাঙালি ব্যবসায়ীরা খাতুনগঞ্জে সব সময়ই দাপুটে ছিলেন। কারণ তাদের পুঁজি তুলনামূলক ভালো ছিল। পণ্য আমদানির অনুমতি ছিল। বাঙালি ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির অনুমতি কদাচিৎ পেতেন। অবাঙালি ব্যবসায়ীদের অনেকে খাতুনগঞ্জের পাশাপাশি করাচিতেও ব্যবসা করতেন। ফলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা তাদের আমদানি করা পণ্য পাইকারিতে কিনে নিতেন। অনেক বাঙালি ব্যবসায়ী অবাঙালিদের পণ্য আমদানি অনুমতিপত্র কাজে লাগাতেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে বাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে আসে বাণিজ্য। সোনালি দিনের শুরুটাও স্বাধীনতার পর।স্বাধীনতার পর পণ্য আমদানিতে লাইসেন্স প্রথা ছিল। যারা লাইসেন্স পেত, তারা খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকের কাছে তা বিক্রি করে দিত। অর্থাৎ আমদানি করতেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। সে সময় দেশের আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের ৭৫-৮০ শতাংশ বেচাকেনা হতো খাতুনগঞ্জে। লাইসেন্সিং প্রথা উঠে যাওয়ার পর তিন দশক আগে থেকে যে কেউ আমদানি করতে পারে। তাতে খাতুনগঞ্জ ছাড়িয়ে ঢাকাসহ অন্য এলাকায় আমদানিকারকের সংখ্যা বেড়েছে। এতে খাতুনগঞ্জের অংশীদারিও কমেছে। কার্যত,বর্তমানে সিংহভাগ পণ্যই ট্রাকযোগে আনা-নেওয়া হয়। সমুদ্রপথেও আমদানি করা পণ্য এখানে গুদামজাত করা হয়। আশির দশক থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার বাণিজ্য জোরদার হতে শুরু করে। এ সময় খাতুনগঞ্জে ব্যাপক পুঁজির আগমন ঘটে। পণ্য আমদানির সঙ্গে ডিও বেচাকেনা চলে। কাগজভিত্তিক লেনদেনে বিশ্বাস আর আস্থা ছিল ব্যবসায়ীদের পুঁজি। একসময় দেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা পুরোপুরি এ বাজারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আজও নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য পাওয়া যায় এ বাজারে। এখানকার পণ্যসামগ্রী দেশের প্রায় সবখানে সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে দেশের ভোগ্যপণ্য লেনদেনে ৫৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে এ বাজার। দেশের প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখা আছে এখানে। প্রতি কর্মদিবসে ব্যাংকগুলোয় কয়েকশ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এখানে অনেক ট্রেড ইউনিয়ন ও ব্যবসায়ীদের সংগঠনও গড়ে উঠেছে।
নগরের খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ ও চাক্তাইয়ে ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা আছে। নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইন্সুরেন্স কোম্পানির একাধিক শাখা, শেয়ার কেনাবেচার ব্রোকারেজ হাউজসহ আমদানিকৃত পণ্য প্রয়োজনীয় ট্যাক্স দিয়ে খালাসের কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট অফিস রয়েছে। আরও আছে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও মানিগ্রামসহ অর্থ বিনিময়ের এজেন্ট অফিস। পণ্য, চিঠি, অর্থ ও ডকুমেন্ট দেওয়া-নেওয়ার জন্য পোস্ট অফিসসহ কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস রয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের থাকা-খাওয়ার হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ফার্মেসি প্রভৃতি তো আছেই।এখানে আড়ত, দোকান ও গুদামঘরের সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। বলা বাহুল্য, সত্তর-আশির দশকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একদল শিক্ষিত তরুণ ভাগ্যবদলের অন্বেষণে যুক্ত হন এই খাতুনগঞ্জে। তাদের কেউ এসেছিলেন পেটের দায় মেটাতে চাকরির সন্ধানে, কেউ প্রায় পুঁজিশূন্য হাতে ব্যবসা করতে কিংবা কেউ এসেছিলেন চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার মানসে। ‘খাতুনবিবির’ উর্বর জমিতে নতুন করে জীবনের চাষ শুরু করেছিলেন তারা। চার থেকে পাঁচ দশকের ব্যবধানে সেই তরুণদের মেধা এবং কর্মদক্ষতায় পুরো বাংলাদেশ দেখল খাতুনবিবির আকাশে উজ্জ্বল বাণিজ্যিক সূর্যের উদয়। এছাড়া বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ কিংবা একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেলের বাজারে টিকে, আবুল খায়ের, এমইবি, মোস্তফা, এসএ, এনজিএসসহ ১২টি গ্রুপের প্রতিযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সকাল থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে ডিওর হাতবদল হতো, ব্রোকারদের জটলা লেগে থাকত। আবার এস আলমসহ অন্য কোম্পানির চিনি, বিএসএম গ্রুপের গম নিয়ে সরগরম থাকত বাজার। এখানে দরবৃদ্ধির উত্তাপের সঙ্গে দরপতনে পিনপতন নীরবতাও থাকত ছায়াসঙ্গী হয়ে। শুধু কি ভোজ্যতেল, গম-চিনি। সঙ্গে ছিল ভোগ্যপণ্যের অন্য অনুষঙ্গগুলোও।
অপরদিকে দৈনিক খবরের কাগজ বলছে, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে একসময় ব্যবসা হতো শুধু বিশ্বাসের ওপর। মুখের কথায় শত শত কোটি টাকার পণ্য পাঠিয়ে দেওয়া হতো। আর্থিক প্রতারণার কারণে ধীরে ধীরে সেই আস্থায় সংকট তৈরি হয়। ১৯৮৬ সালে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে প্রথম প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৬৮টি আর্থিক প্রতারণার ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া চেক প্রতারণার মামলা-তো নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ব্যবসায়ীরা আক্ষেপ করে বলছেন, মাত্র দুই দশক পেরিয়ে এখন খাতুনগঞ্জে এমন হাঁকডাক নেই। সে সময়ের বড় গ্রুপগুলোর অনেকেই ব্যবসা গুটিয়েছে। ব্যবসা পরিবর্তন করে অন্য শিল্পে সরব হয়েছে। কমেছে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। সেই জায়গা নিয়েছে ঢাকার গুটিকয়েক বড় শিল্পগ্রুপ। একসময় যে খাতুনগঞ্জ থেকে বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের বাণিজ্যের উত্থান হয়েছিল, তা এখন ম্রিয়মাণ।
খাতুনগঞ্জের জৌলুশ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সোনালি যুগের শেষপ্রান্তে চলে এসেছে খাতুনগঞ্জ। আগের মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেই এখন। লেনদেন বাড়লেও ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমেছে। তাতে প্রতিযোগিতাও কমে গেছে। প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়ার জন্য যা ইতিবাচক নয়। ভোগ্যপণ্যের বাজারের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ও পরিবর্তন এসেছে। তাতে খাপ খাওয়াতে না পেরে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বড় শিল্পগ্রুপের অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কেউবা ব্যাংকের খেলাপি হয়ে যাওয়ায় ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারেনি। মূলত চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খাতুনগঞ্জের জৌলুশও কমে এসেছে। আবার দেশে নিত্যপণ্য মোড়কজাতের পরিমাণও বাড়ছে। তাতে খোলা পণ্যের অংশীদারি কমে খাতুনগঞ্জের অংশীদারি কমে গেছে।