চট্টগ্রাম

থানায় সেবাপ্রার্থী নেই, দলীয় নেতাকর্মীর ভিড়

শুক্রবার সন্ধ্যা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার চান্দগাঁও থানার সামনে দায়িত্বরত কয়েকজন সেনাসদস্য। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে। তাদের সবাই সাদা পোশাকে। আশেপাশে দেখা যায়নি কোনো সেবাপ্রার্থী। হয়নি কোনো ডায়েরি-মামলা। তবে ভিড় ছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর।

একই চিত্র দেখা গেছে নগরের খুলশী থানায়। সেখানেও ‘পাহারায়’ আছেন সেনাসদস্যরা। সাথে ছিলেন আনসার সদস্য। ছিলেন না কোনো সেবাপ্রার্থী। কার্যক্রম সকাল থেকে শুরু করা হলেও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত এই থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়েছে দুটি।

শুক্রবার শুধু চান্দগাঁও-খুলশী নয়, সিএমপির ১৬ থানার মধ্যে ১১টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে আংশিকভাবে। চারদিন বন্ধ থাকার পর থানাগুলোয় সেনা সদস্যদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ডিউটিতে যোগ দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট বিকেল থেকে চট্টগ্রামের অধিকাংশ থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। অনেক জায়গায় অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও নথি লুট হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে।

সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, যেসব থানায় হামলা হয়নি বা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেসব থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

সিএমপির জনসংযোগ সূত্র জানায়, চালু হওয়া ১১টি থানার মধ্যে রয়েছে—চান্দগাঁও, বায়েজিদ বোস্তামী, খুলশী, পাঁচলাইশ, সদরঘাট, চকবাজার, বাকলিয়া, পাহাড়তলী, আকবরশাহ, কর্ণফুলী ও বন্দর। এছাড়া হালিশহর, কোতোয়ালী, ডবলমুরিং এবং ইপিজেড থানার নিউমুরিং ফাঁড়ির কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু হবে শনিবার। নগরীর দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পতেঙ্গা থানার কার্যক্রম শুরুর জন্যে নতুন ভবন খোঁজা শুরু হয়েছে।

সরেজমিনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে খুলশী থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার মূল ফটক দিয়ে প্রবেশমুখে দুজন সেনাসদস্য থানার নিরাপত্তায় রয়েছেন। এছাড়া সেখানে ছিলেন একজন আনসার সদস্য। আশেপাশে আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা সবাই সাদাপোশাকে। তখনো কোনো সেবাগ্রহীতাকে থানায় প্রবেশ করতে দেখা যায়নি।

থানা সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার থানাটির উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার ১৮ জনের মধ্যে ১৪ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার ২১ জনের মধ্যে ১৯ জন এবং ৪৫ জন ফোর্সের মধ্যে ৩৭ জন উপস্থিত ছিলেন। থানার নিরাপত্তায় আছেন ২০ জন সেনাসদস্য এবং দুজন আনসার সদস্য।

খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবিরুল ইসলাম সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘আমরা বেলা সাড়ে ১০টা থেকে আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছি। সব অফিসার সাদা পোশাকে ডিউটি পালন করছেন। আজ আমার থানার ৯৫ শতাংশ পুলিশ সদস্য উপস্থিত আছেন। আশা করছি সময়ের সাথে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। যারা সেবাপ্রার্থী আছেন তাদেরকে থানায় এসে সেবা নেওয়ার অনুরোধ করছি। ধীরে ধীরে সেবার পরিধি বাড়বে।’

এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপচারিতার মধ্যেই ওসির সরকারি মুঠোফোন নম্বরে ফোন আসে একজন সেবাপ্রার্থীর। তিনি জানান তার গাড়ির কাগজপত্র হারিয়েছে। ওসি তাকে সাথে সাথেই থানায় এসে সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেন।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সরেজমিনে চান্দগাঁও থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার ফটকের ভেতরেই পাহারায় আছেন একাধিক সেনাসদস্য। সাথে আছে দুজন আনসার সদস্য। তবে এদিন কোনো সেবাপ্রার্থী থানায় আসেননি। থানার পুলিশ সদস্য যারা দায়িত্বে আছেন, সকলেই ছিলেন সাদা পোশাকে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক থানায় অবস্থান করে দেখা গেছে, একে একে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থানায় আসছেন দলবল নিয়ে। এদের মধ্যে অনেকে এসেছেন ফুলের তোড়া নিয়ে। নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনও নেতাকর্মীদের নিয়ে এসেছিলেন সন্ধ্যার আগে। তারা এসে থানা পরিদর্শন করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে কুশল বিনিময় করে চলে যান।

চান্দগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক মোমিনুল হাসান বলেন, ‘আমরা সকাল থেকে কাজে যোগদান করেছি। আমাদের ইন্টারনেটের ফাইবার ক্যাবল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি গ্রহণ আপাতত বন্ধ রয়েছে। ম্যানুয়ালি কার্যক্রম চলছে। তবে আগামীকাল থেকে আশা করা যায় অনলাইন সেবাও চালু হবে।’

চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুল কবির বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট দুর্বৃত্তরা আমাদের থানায়ও আক্রমণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা সবাই অনড় থাকায় সেটা হয়নি। কর্মবিরতির মধ্যেই আজ থেকে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে পারবো।’

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘আমাদের ১৬ থানার মধ্যে ১১টি থানার কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সেসব থানায় পুলিশ সদস্যরা যোগদান করেছেন। তিনটি থানা ও একটি থানার ফাঁড়ির কার্যক্রম আগামীকাল থেকে শুরু করা হবে। আর পতেঙ্গা থানা যেহেতু দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়ে গেছে সেই থানার জন্য নতুন ভবন খোঁজা হচ্ছে।’

সন্ধ্যা ৭টার দিকে খুলশী থানা পরিদর্শনে যান নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস্) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া, অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহাম্মদ এবং উপকমিশনার (সদর) মো. আব্দুল ওয়ারীশ।

থানা প্রাঙ্গন পরিদর্শন শেষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। এলাকার জনগণের সহায়তাও আমরা নিচ্ছি। সকলের সহযোগিতায় আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যে কার্যক্রম শুরু করেছি। খুব দ্রুতই ফুল ফোর্স নিয়ে আমরা কার্যক্রম শুরু করবো।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুধু শিক্ষার্থীরা নন, আমরা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ আলেম-ওলামা যারা আছেন সবারই সহযোগিতা নিচ্ছি এবং পাচ্ছি। গণমাধ্যমের কাছ থেকেও আমরা সহযোগিতা চাই।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ প্রশাসন পুরোদমে কাজ শুরু করতে কতদিন লাগতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে একটি নির্দেশনা এসেছে। সেখানে যত দ্রুত সম্ভব পুলিশ সদস্যরা যেন কাজে যোগদান করেন, তা বলা হয়েছে। আমাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফোর্স এরই মধ্যে কাজে যোগদান করেছে। আমরা পুলিশ সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করছি এবং তারা আসছেন। দিনদিন এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।’

অধীনস্ত পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উত্থাপনকৃত দাবি-দাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের আইজিপি স্যার আজকেই নির্দেশনা দিয়েছেন। যেসব দাবি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে সেসব দাবি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আলাপ আলোচনা করবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *