চট্টগ্রাম

সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশি সম্পত্তি নিয়ে নতুন তথ্য

অবিশ্বাস্য! সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ এবং তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরীর নামে বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকা ও বিলাসবহুল দুবাইয়ে, বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে! তাঁদের বিদেশি ব্যাংক হিসাবগুলোতে এত বিপুল টাকা জমা রয়েছে যে গুনতে গেলে সময় লাগবে! কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে এখন পর্যন্ত তাঁরা বা তাঁদের পরিবারের কেউ একটি পয়সাও বাইরে নিতে পারেননি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এত বিশাল সম্পদ কোথা থেকে এলো? কীভাবে এমন অসম্ভব ঘটনা ঘটতে পারে?

সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ২০১৮-২৩ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন। তবে বিদেশে তাঁর বিপুল সম্পদের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বিদায়ী সরকারে তাঁকে আর মন্ত্রী করা হয়নি। অন্যদিকে রুখমিলা জামান চৌধুরী বর্তমানে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যা এবং তাঁদের নামে থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলোকে জানানো হয়েছে যে, আগামী ৩০ দিনের মধ্যে এসব হিসাবে কোনো লেনদেন করা যাবে না। এমনকি তাঁদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সোমবার (১২ আগস্ট) এই নির্দেশনা পাঠিয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং বিএফআইইউ প্রধানের পদত্যাগের পর সংস্থাটি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিপত্র থেকে জানা যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যথাক্রমে র‍্যাপিড র‍্যাপ্টর এফজিই (কম্পিউটার ও সফটওয়্যার) এবং জেবা ট্রেডিং এফজিই (ভবন নির্মাণ সামগ্রী) নামে দুটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তার ব্যাংক হিসাব রয়েছে দুবাই ইসলামিক ব্যাংক, ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকের দুবাই শাখায়, যেখানে মোট ৩৯,৫৮৩ দিরহাম এবং ৬,৬৭০ ডলার জমা রয়েছে। এছাড়াও, তিনি ২০১৭ সাল থেকে গত মাস পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৬টি স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করেছেন।

রুখমিলা জামানের নামে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর এবং নভেম্বর মাসে দুবাইয়ের আল-বারশা সাউথ-থার্ড এলাকায় দুটি স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করা হয়, যার মূল্য ২২ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ দিরহাম বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রেও তাদের সম্পদের খোঁজ পেয়েছে বিএফআইইউ। ২০২১ সালের ৮ মার্চ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টিডি ব্যাংকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর জিটিএস প্রপার্টিজ এলএলসি হিসাবে ৪৫ হাজার ৩৪০ ডলার জমা হয়েছে। এই অর্থ জমা হয় ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংক এবং এইচএসবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে। কিছু অর্থ মার্কিন কোম্পানি ক্যাপিটাল ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম লিমিটেড থেকে এসেছে।

বিএফআইউর নথি থেকে জানা যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরামিট প্রপার্টিজ এলএলসি এবং জিটিএস প্রপার্টিজ এলএলসির পক্ষে ফার্স্ট আমেরিকান টাইটেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে ১৭ লাখ ৬৫ হাজার ডলার জমা হয়েছে। এছাড়াও, তিনি নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেডের মাধ্যমে ২০০৫ সাল থেকে ৯টি স্থাবর সম্পত্তি কিনেছেন। উল্লেখ্য, আরামিট প্রপার্টিজ এলএলসি, জিটিএস প্রপার্টিজ এলএলসি এবং নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেড—এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত।

বিএফআইইউ কর্মকর্তারা বলেছেন, আপাতত শুধু দুই দেশের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলেও, যুক্তরাজ্যে তাদের আরও বেশি সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত নির্বাচনের আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল যে, একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ ও ব্যবসা রয়েছে। পরে এই মন্ত্রী হিসেবে সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে চিহ্নিত করা হয়। জানা যায়, তিনি যুক্তরাজ্যে স্ত্রী রুখমিলা জামান এবং মেয়ে জেবা জামানের নামে কোম্পানি খুলেছেন এবং পারিবারিক মালিকানায় থাকা আরামিট গ্রুপের নামে যুক্তরাজ্যে আরেকটি কোম্পানি খুলেছেন। গত মার্চের সংবাদ সম্মেলনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনে তার ব্যবসা এবং সম্পদের কথা স্বীকার করেন।

ইউসিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা, প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে অন্যতম শেয়ারহোল্ডার পারটেক্স গ্রুপের মালিক পরিবারকে ইউসিবি থেকে ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তখন ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুখমিলা জামান। তবে রুখমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিচালনা করেন বলে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সরকার পতনের পর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার দাবিতে দেড় শতাধিক শেয়ারধারী আন্দোলন শুরু করেছেন। গত বৃহস্পতিবার গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা এই দাবি জানান। এ সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ এবং ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ তোলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে কিছু শেয়ারধারী জানিয়েছেন, রুখমিলা জামান ব্যাংকের চেয়ারপারসন হলেও কার্যত সাইফুজ্জামান চৌধুরীই ব্যাংকটি পরিচালনা করেন এবং তার ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের কারণে’ ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ার পথে। ওই চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে, যা ‘ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা লুট করে’ অর্জিত হয়েছে। চিঠিতে আরও অভিযোগ করা হয়, ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ‘অবাধ লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার’ করা হয়েছে, যার ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সাল শেষে ২ হাজার ৭৮২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরীর মতে, দেশের ডলার সংকটের মূল কারণ হলো প্রভাবশালীদের দীর্ঘমেয়াদী অর্থ পাচার। তিনি বলেন, এটা সর্বজনবিদিত যে প্রভাবশালীরা অর্থ পাচার করেছে, এমনকি ব্যাংক দখল করেও অনেকে অর্থ পাচার করেছে। এই সংকট সমাধানের জন্য তিনি দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার ও ভবিষ্যতে অর্থ পাচার রোধের ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি, যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি করে সেই অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং রুখমিলা জামান চৌধুরী বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং দুবাইয়ে তাদের সম্পদের ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত মার্চে এক সংবাদ সম্মেলনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমার এই সম্পত্তি লন্ডনের ব্যবসা থেকে করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে টাকা নেওয়ার কোনো সিস্টেম নেই। তাই দেশ থেকে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

সাবেক ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সন্তান। বিদেশে আমাদের পারবারিক ব্যবসা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে যখন আমার পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে তখন ১৯৯১ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করেছি এবং আমার বাবা ১৯৬৭ থেকে শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসা আমি প্রসারিত করেছি। আমিও চাইব আমার সন্তান আমার মতো রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী হোক।’

নির্বাচনী হলফনামায় কোনো তথ্য গোপন করা হয়নি দাবি করে চট্টগ্রাম-১৩ আসনের এমপি বলেন, ‘বিদেশি সম্পত্তি উল্লেখ করতে হবে, হলফনামায় এ রকম কোনো অপশন নেই। এ জন্য আমি হলফনামায় কোনো সময় বিদেশি সম্পত্তির তথ্য দিইনি। আমি আমার বিদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য একত্র করিনি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *