মাইনাস টু ফর্মুলার বিষয়ে সজাগ বিএনপি
অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা ও যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলেছে বিএনপি। তবে সংস্কার ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের পরিবর্তিত সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘সংশয়’ ও ‘সন্দেহ’ তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
বিশেষ করে বিএনপির ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নেতাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে বর্তমান সরকার সব বিষয় স্পষ্ট না করায় সন্দেহের নানা ডালপালা রাজনৈতিক মহলে বিস্তার লাভ করেছে।
যদিও বিএনপির ও জোটের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সরকারকে আপাতত ‘সময় দেওয়া’ উচিত এবং এটি সর্বোচ্চ এক বছর হতে পারে। তাও নির্ভর করবে সরকারের কার্যক্রমের ওপর।
তাদের মতে, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কার প্রয়োজন। রাষ্ট্রের কাঠামোতে গুণগত পরিবর্তন না এলে পরবর্তী সরকারকে চাপে থাকতে হবে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের পক্ষে মত তাদের। তবে এক বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের গাফিলতি দেখলে সোচ্চার হবে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো।
চাপ তৈরি করতে বক্তব্য-বিবৃতি এমনকি নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে কর্মসূচিও দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপি ও সমমনাদের।
জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘সংস্কারের প্রস্তাব বিএনপি সর্ব প্রথম ৩১ দফার দাবির মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরেছে।
এখন অন্তর্বর্তী সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রনেতারা, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সব গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল সংস্কারের বিষয়ে একমত।
সবাই যেহেতু সংস্কার চায়, তাই সবার কাছে সংস্কারের কর্মকাণ্ডও পরিষ্কার হওয়া উচিত। কিন্তু সরকার এসব বিষয় স্পষ্ট করছে না। যে কারণে সন্দেহ ও সংশয়ের জায়গা তৈরি হয়েছে। গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে আলোচনার মাধ্যমে সরকার সন্দেহ-সংশয় সহজেই দূর করতে পারে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আপনার লক্ষ্য পরিষ্কার হলে সেটি প্রকাশ করতে সমস্যা থাকার কথা না। ভালো কিছুও অপ্রকাশ্যে করতে চাইলে সেটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হবে। বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডের দিকে আমাদের তীক্ষè নজর থাকবে। যত দিন সরকার ট্র্যাকে থাকবে, তত দিন সমর্থন থাকবে। ট্র্যাকের বাইরে গেলে আমরা কর্মসূচিতে যাব।’
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক বলেছেন, মূলত এই সংশয় ও সন্দেহের কারণ দুটি। একটি হচ্ছে এক-এগারোর সময়ের মতো এই সরকার ক্ষমতায় থেকে যেতে পারে এবং নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে পারে। সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে এই সরকার কাজ করলেও সেটি জাতির সামনে পুরোপুরি খোলাসা করেনি।
সন্দেহ বা সংশয় জোরালো হয়েছে, সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কিছু বক্তব্য এবং এক-এগারোর সময়কার কেউ কেউ বর্তমান সরকারে দায়িত্ব পাওয়ায়। বলা হচ্ছে, নাগরিক কমিটির ব্যানারে অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালিত হচ্ছে। এদের কেউ কেউ এক-এগারোর সময় মাইনাস-২ ফর্মুলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ কেউ প্রশাসনের ছত্রছায়ার দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেন, যা দৃষ্টিকটু।
দ্বিতীয়ত, সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না থাকা, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য ছয় মাস বা কয়েক বছরও লাগতে পারে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কারও কারও এমন বক্তব্য সংশ্লিষ্টদের কাছে ক্ষমতা প্রলম্বিত হওয়ার লক্ষণ মনে হচ্ছে।
সন্দেহ ও সংশয় নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘১/১১-এর মতো ক্যাম্পেইন দেখা যাচ্ছে। সে সময় বিরাজনীতিকীকরণের চক্রান্ত হয়েছে। সেই শঙ্কা এখনো রয়েছে।’
বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান সরকার গত ১৬ বছরের আবর্জনা পরিষ্কার করে ঘরকে বাসযোগ্য করবে এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে। সে পর্যন্ত আমাদের শর্তহীন সমর্থন থাকবে বর্তমান সরকারের প্রতি। তারা রাইট ট্র্যাক (সঠিক রাস্তা) থেকে সরে গেলে সমর্থনও সরে যাবে। গাফিলতি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে সোচ্চার হবেন বিএনপি ও জোটের নেতারা। চাপ তৈরি করতে বক্তব্য-বিবৃতি এমনকি নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে কর্মসূচিও দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে।’
জানা গেছে, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ স্পষ্ট না করার কারণেই মূলত অসন্তুষ্টি ও অস্থিরতা রয়েছে বিএনপিতে।
এ অবস্থায় দলের নেতারা বলছেন, সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। সরকারের সঙ্গে যাতে কোনো ধরনের দূরত্ব তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সতর্কও থাকবেন তারা। তাই সহসাই সরকারের কার্যক্রম নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না তারা।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে আপাতত ‘সময় দেওয়ার’ বিষয়ে দলের প্রায় সব নীতিনির্ধারক একমত। ওই নির্দিষ্ট সময় ঠিক কত দিন, তা স্পষ্ট করেনি বিএনপি। তবে এ নিয়ে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্তত তিনটি বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির ডানপন্থি এক নেতা জানান, ‘এটি সর্বোচ্চ এক বছর সময় দেওয়ার পক্ষে বেশিরভাগ নেতা মত দিয়েছেন। সেটি নির্ভর করবে সরকারের কার্যক্রমের ওপর। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা একমত হয়েছেন, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। রাষ্ট্রের কাঠামোতে গুণগত পরিবর্তন না এলে পরবর্তী সরকারকে চাপে থাকতে হবে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের পক্ষে মত বিএনপির। তবে এক বছরের মধ্যে এসব সংস্কার করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পরামর্শ রয়েছে দলটির।
বিএনপি নেতাদের দাবি, গত ১২ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। বৈঠকে দলের শীর্ষ নেতারা উদ্বেগ ও দাবি তুলে ধরেছেন। তাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টাও একমত পোষণ করেছেন। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন চেয়েছে বিএনপি।
কারণ তারা মনে করে, পরবর্তী সংসদ নির্বাচন জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই বৈঠকের পর দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
এই বৈঠকের আগে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে-পরে বিএনপি নেতাদের কেউ অতিদ্রুত, কেউ তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন। তবে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর সেই অসন্তুষ্টি কাটতে শুরু করেছে।
ওই বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘একটা নির্দিষ্ট সময় লাগবে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে। আমরা তাদের সেই সময়টি অবশ্যই দিয়েছি। সরকারের সব বিষয়ে সমর্থন দিয়েছি।’
বিএনপি নেতারা মনে করেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে গিয়ে অবস্থান নেন।
বিএনপির দীর্ঘদিনের দাবি, নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে তাদের দাবির প্রথম ধাপ পূরণ হয়েছে। এখন বাকি আছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের একটি সরকার গঠন করা।
তারা মনে করেন, রাজনীতিবিদদের দেশ পরিচালনা আর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে দেশ পরিচালনা এক নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তারা হয়তো ভালো ভালো আইডিয়া তৈরি ও পরিকল্পনা করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন। এ কাজ করতে রাজনীতিবিদের প্রয়োজন রয়েছে।
কারণ তাদের সঙ্গে জনগণের একটা সম্পর্ক থাকে, যেটা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তাছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে মানুষ আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ভুলে যাবে। ফলে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে আবারও দেশ অনির্বাচিত অথবা আওয়ামী লীগের হাতে চলে যেতে পারে।
এমন সুযোগ যাতে তৈরি না হয়, সেজন্যই তাদের সভা ও সমাবেশে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি নির্বাচনের দাবি জোরালোভাবে তুলবে ধরবে।