ব্যাটারি রিকশা ঘিরে মাসে দেড় কোটি টাকার চাঁদাবাজি
চট্টগ্রাম নগরীতে দিন দিন বাড়ছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য।গত দু’বছরে এসব রিকশার সংখ্যা বেড়েছে দুই থেকে তিন গুণ।গাড়িগুলো মজবুত করতে এবার ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রাকের বাম্পার।এসব ভারী লোহার বাম্পার কেটে গাড়ি চারপাশের বডিতে লাগানো হচ্ছে।ফলে এসব গাড়ির সামান্য আঘাতেও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে মানুষ ও অন্যান্য গাড়ির।
নগরীর ১৬টি থানা এলাকা থেকে প্রতিমাসে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব অবৈধ ব্যাটারি রিকশা থেকে দেড় কোটি টাকার ওপরে চাঁদা তোলা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকার ভাগ যায় ট্রাফিক পুলিশ, থানা পুলিশ, স্থানীয় নেতা, কথিত সাংবাদিক থেকে শুরু করে ওপরের সারির নেতাদের কাছেও।
তাই বারবার অভিযান চালালেও কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব রিকশা। এছাড়া এসব গাড়ি সামনে যে গতিতে চলে রিভার্স গিয়ারে পেছনেও চলে একই গতিতে। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঘটছে। আর গাড়ির চালকের আসনে বেশিরভাগই প্রতিবন্ধী ও শিশু।
শনিবার (১১ নভেম্বর) সরেজমিন নগরীর চকবাজার, খুলশী, পাহাড়তলী, আকবরশাহ, হালিশহর ও পতেঙ্গা থানা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন অলিগলির সড়কগুলোর দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসব গাড়ির ফলে অন্যান্য গাড়ি আসা-যাওয়াতে বেগ পেতে হচ্ছে। সবসময়ই যানজট লেগে থাকছে রাস্তায়।
এছাড়া চকবাজার এলাকায় ধুনিরপুলি মোড়ে দীর্ঘক্ষণ দেখা গেছে ব্যাটারিচালিত রিকশার জটলা। এর মধ্যে টহল পুলিশের একটি গাড়ি এলে এসব গাড়ি ধুনিরপুল থেকে খানিকটা সরে পশ্চিম বাকলিয়া সরকারি স্কুলের সামনে গিয়ে অবস্থা নেয় এবং সেখান থেকে যাত্রী ওঠানামা করতে থাকে। পুলিশ দেখে দ্রুতগতিতে পালাতে গিয়ে কয়েকটি ব্যাটারি রিকশা দুর্ঘটনাও ঘটিয়েছে। এদিকে বাকলিয়া এক্সেস রোডটি সম্প্রতি যান চলাচলে উন্মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই দু’পাশ দখলে নিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। বাকলিয়া ও চকবাজারে এসব গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করেন দেলোয়ার নামের এক ব্যক্তি।
পতেঙ্গার কাঠগড়-মাইজপাড়ায়ও ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য বেশি দেখা গেছে। এসব এলাকায় গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন রাশেদ ও রুবেল। ধুপপাড়া থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এলাকায় আগের চেয়ে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল। এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন শাহাবুদ্দিন ও হেলাল। একইসঙ্গে পতেঙ্গার আউটার রিং রোডেও দ্রুতগতিতে দাপিয়ে বেড়ায় এসব ব্যাটারিচালিত গাড়ি।
খুলশী থানার ব্যস্ততম চার রাস্তার মোড় টাইগারপাসেও অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে ব্যাটারিরিকশা। এই এলাকায় গাড়িগুলো দেখভাল করেন সুমনের নেতৃত্বের একটি সিন্ডিকেট। তার নিয়ন্ত্রণে আছে একশয়েরও বেশি গাড়ি। সিটি কর্পোরেশন ভবনের প্রবেশমুখে বটতল এলাকায় তার দুটি গ্যারেজ আছে।
অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ে জায়গা ও বিদ্যুৎ অবৈধভাবে ব্যবহার করেন সুমন। তার গ্যারেজেই তৈরি করা হয় এসব বাম্পার লাগানো অবৈধ রিকশা, প্রতিদিন দেওয়া হয় চার্জও।
রেলের জায়গায় গ্যারেজের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (পূর্ব) সুজন চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নেবো আমি।’
জানা গেছে, ২০১৭ সালে হাইকোর্ট মহাসড়কে তিন চাকার ব্যাটারিরিকশাসহ ২২ ধরনের যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দেন। তবে এ আদেশ ‘মহাসড়ক’ কথা উল্লেখ থাকলেও ছিল না ‘সড়ক’ কথাটি। তাই আইনের ফাঁক বের করে এসব গাড়ির নিয়ন্ত্রণকারীরা মহাসড়কের বদলে অলিগলির সড়কে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রায় ৬০০-৮০০ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে আকবরশাহ থানা এলাকায়। এসব গাড়িচালকদের মামলা দিলেও তাদের শিক্ষা হচ্ছে না।’
টাইগারপাস মোড়ে কথা হয় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট আনোয়ারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন গাড়ি আটক থেকে শুরু করে ডাম্পিং ও মামলা দেওয়া হয়। কিন্তু তবুও দমানো যাচ্ছে এসব গাড়ি। এছাড়া এসব গাড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রাকের বাম্পার। এসব ভারী লোহার বাম্পার ব্যবহারের ফলে ব্যাটারিচালিত রিকশার আঘাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য গাড়ি। এমন দুর্ঘটনায় মানুষের ক্ষতিও হচ্ছে বেশি।’
তিনি বলেন, ‘এসব গাড়ির চালকরা কৌশলে রিংবিহীন চাবি রাখে। রিকশাগুলো সামনে যে গতি রিভার্সে পেছনে একই গতিতেও ছুটে।’
ট্রাফিক–দক্ষিণ বিভাগের (টিআই–প্রশাসন) অনিল বিকাশ চাকমা বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো নিয়মিত আটক করা হচ্ছে এবং মামলাও দেওয়া হচ্ছে।’
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ‘মেয়রের সঙ্গে অবৈধ গাড়িগুলোর ডাম্পিংয়ের জায়গা নিয়ে আলোচনা চলছে। জায়গা ঠিক হলে বিভিন্ন অবৈধ গাড়ির বিষয়েও কঠোর ব্যবস্থা নেবে সিএমপি।’