চট্টগ্রামবাঁশখালী

এস আলমের আশীর্বাদে বিএনপি নেতার ভাগ্য পরিবর্তনের কাহিনী

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারায় এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। প্রকল্পটির শুরুতেই এর বিরোধিতা করেন স্থানীয় চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মোহাম্মদ লেয়াকত আলী। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল তার সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। লেয়াকত আলী তখন বসতভিটা গোরস্থান রক্ষা কমিটির সমন্বয়ক হিসেবে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

সংঘর্ষের পরপরই লেয়াকত আলী এস আলম গ্রুপের সমর্থন পান। এ ক্ষেত্রে সহায়তা করেন তৎকালীন কোস্ট গার্ডের দায়িত্বে থাকা এক নৌবাহিনী কর্মকর্তা। পরবর্তীতে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে ওই কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় এবং পরে গুম-খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।

স্থানীয়রা জানান, প্রথম দিকে বসতভিটা গোরস্থান রক্ষা কমিটির সমন্বয়ক হিসেবে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের ঘোর বিরোধিতা করলেও এস আলমের সাথে সমঝোতা করে নিজেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পক্ষে যা যা করার তা করবেন বলে ঘোষণা দেন। এস আলম গ্রুপের সঙ্গে লেয়াকতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাকে দ্রুত ধনী করে তোলে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জমি কেনা-বেচা, শ্রমিক সরবরাহ এবং স্ক্র্যাপ ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল লেয়াকতের হাতে। এই সম্পর্কের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও তার সামনে দুর্বল হয়ে পড়েন।

২০২১ সালে বাঁশখালী থানার ১০০ গজ দূরে বিএনপির একটি জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কটূক্তি করে বক্তব্য রাখেন লেয়াকত আলী। তার বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি, দস্যুতা এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডসহ ২১টিরও বেশি মামলা থাকলেও তাকে গ্রেপ্তার করতে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা ভয় পেতেন বলে আলোচনা আছে। অভিযোগ আছে, এস আলমের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকার সুবাদে লেয়াকত আলীকে গ্রেপ্তার করতো না পুলিশ।

২০০৩ সালে প্রথম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর, ২০০৯ ও ২০১৪ সালে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার কারণে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি।

২০১৬ সালের সংঘর্ষের পর লেয়াকত আলী এস আলমের সঙ্গে সমঝোতা করে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য গণ্ডামারার জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রির সুযোগ করে দেন বলে অভিযোগ আছে। এই সমঝোতার মাধ্যমে তিনি দ্রুত কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠেন বলেও স্থানীয়দের অভিযোগ। এছাড়াও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই অর্থে তিনি ও তার স্ত্রী একের পর এক জমি কিনেছেন বলে স্থানীয়রা জানান।

এস আলমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার পর লেয়াকত আলী তার পিতার নামে ‘হাজী দুদুমিয়া ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে গণ্ডামারা আনোয়ারা বেগম স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালিত হয়, যা ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি লেয়াকত আলী গণ্ডামারার এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টে ড্রেজিংয়ের জন্য নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় সংঘর্ষে জড়ায় তার সমর্থকরা। পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় লেয়াকতের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও তিনি একই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান।

এ ঘটনার পর এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ ক্ষেপে যান। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনের সাথে লেয়াকত অনুসারীরা সংঘর্ষে জড়ানোর পর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের একজন সমন্বয়ক নিজেই তৎকালীন ওসির সাথে থানায় জরুরি বৈঠকে বসেন। এস আলমের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিন লেয়াকত আলীকে ধরতে পারলে প্রাডো জিপ উপহার দেবেন বলে জানান। কিন্তু ওসি তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, উপহারের গাড়ি হলেও দুদকের জালে আটকে যাবেন তিনি।

তখন আত্মগোপনে চলে যান লেয়াকত। এক পর্যায়ে লেয়াকত আলীকে ধরার প্রতিযোগিতা শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে। পরে ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নয়াপল্টন এলাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে লেয়াকতকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি নেতারা এস আলম পরিবারের বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর এস আলম গ্রুপের সঙ্গে লেয়াকত আলীর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

২৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এস আলম বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি যিনি পরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন। এস আলমের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।

এস আলমের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ে লেয়াকত আলী গণমাধ্যমকে বলেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে এবং দল তাকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *