কাস্টমসে অনিয়ম আপাতত ‘বন্দি’
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে টাকা ছাড়া ফাইল না নড়ার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। ফাইলিং থেকে পণ্য খালাস পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানিকারদের টেবিলে টেবিলে টাকা ছড়ানোর দৃশ্যও ছিল অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চলমান পরিস্থিতিতে ঘুষ হয়রানিসহ সব অনিয়ম এখন ‘বন্দি’। ফলে গতি এসেছে সব ধরনের কাজে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে কর্মকর্তাদের চলে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না কেউ কেউ। বাড়তি খরচ থেকে বাঁচতে অতিরিক্ত সময়ে কাজ করিয়ে নিতে কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘুষ লেনদেনেও সন্তুষ্ট তাঁরা। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এমন পরিবর্তনের হাওয়া পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ঘুরে।
রবিবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টা থেকে আনুমানিক দুপুর ৩টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ঘুরে গেছে, সিঅ্যান্ডএফ ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বিল অব এন্ট্রি ও এক্সপোর্টের কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কারো সঙ্গে কথা বলার যেন ফুসরত নেই। এ শাখার কাজ সেরে অন্য শাখায় কাজ করার ব্যস্ততায় তারা ছুটছেন বিরামহীন গতিতে। নিলাম শাখা ছাড়া অন্য সব শাখায় দেখা গেছে কাজ শেষ হচ্ছে দ্রুততার সাথে। শুল্কায়ন ও পণ্য খালাসের বিভিন্ন ধাপে দ্রুত গতিতে কাজ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এশিয়ান ট্রেডিং করপোরেশনের কর্মকর্তা সজল দাশ বলেন, ‘যে কাজ করতে আমাদের অন্যসময় চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগতো। সেই কাজ আজকে (রোববার) শেষ করেছি আধা ঘণ্টার মধ্যে। কাজগুলো সবসময় যে দেরি হয়, এমন না। কিছু কিছু অফিসার ফাইল নিয়ে একটু হয়রানি করে, তবে এখন অফিসারদের (এআরও এবং আরও পর্যায়ে) বদলি হয়েছে। এখন যারা আছেন, তারা যথেষ্ট আন্তরিকভাবে আমাদের কাজগুলো সিরিয়াল মেনে শেষ করে দিচ্ছেন।’
অন্য এক সিএন্ডএফ এজেন্ট রবিউল বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এইচএস কোড। এ ধরনের বড় সমস্যাগুলো সমাধান করাটা খুব প্রয়োজন। এছাড়া অন্যসব কাজে অনেকটা গতি পেয়েছে। হয়রানি নিয়ে গত দুই সপ্তাহ ধরে তেমন কোনো অভিযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমি গত সপ্তাহে চারদিন ফাইলিংয়ের কাজ নিয়ে কাস্টম হাউসে এসেছি। যথেষ্ট দ্রুতভাবেই কাজ শেষ হয়েছে।’
আজমিরি এন্টারপ্রাইজের কর্মী মো. সায়মন বলেন, ‘এখানে কাজের গতি বেড়েছে। কিন্তু আমাদের কাজগুলো সব এক জায়গায় না। ধরেন, এখান থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে আমাদের স্যাম্পল নিয়ে বিএসটিআই, এটমিক ল্যাব বা বিসিএসআইআর গিয়ে সেটার টেস্ট করে আনতে হয়। এ কাজগুলো একেকটি একেক জায়গায়। এগুলো শেষ করে পণ্য খালাসের জন্য আবার কাস্টমসে আসতে হয়, শুল্কায়ন করতে হয়। এগুলো সবসময় ঠিকঠাক অফিস টাইমে শেষ হয় না। এখন আমাদের কোথাও টাকা-পয়সা দিতে হচ্ছে না। কিন্তু কিছু বাড়তি সুবিধা না থাকায় কাস্টাম হাউসে কর্মকর্তারা নিদির্ষ্ট সময়ে অফিস করে চলে যাচ্ছেন। এজন্য আমাদের পোর্ট ডিউটি ফি বাড়তি গুনতে হচ্ছে।’
কাস্টম হাউসের সেকশন-৮ (বি) এর সামনে এজেন্টের কর্মচারী ও কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে দেখা গেছে সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়সেনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলুকে। এসময় পতনের পর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের পরিবর্তন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশের পট-পরিবর্তনে সব জায়গাতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগবে, সেটা খুব স্বাভাবিক। তবে পট-পরিবর্তন তো কোনো ম্যাজিক নয়, যে একদিনে সব পাল্টে যাবে। ভালো কিছু হচ্ছে। তবে সব যে ভালো, তা বলা মুশকিল। এখানে সিস্টেমের পরিবর্তন দরকার। সিস্টেম যদি ঠিক হয়, তাহলে ভোগান্তিও হবে না। আমদানিকারকদেরও পণ্য খালাসে বাড়তি ব্যয় গুণতে হবে না। আর এজন্য সরকারকে আন্তরিকভাবে বিষয়টি দেখতে হবে। সরকার যেহেতু সেক্টর ওয়াইজ (অনুযায়ী) সংস্কারের একটা প্ল্যানে আছে, আশা করবো এটি নিয়েও ভালো কিছু হবে।’
কাস্টম হাউস গতিশীল হওয়া প্রসঙ্গে কথা হলে সংস্থাটির যুগ্ম-কমিশনার মো. নাজিউর রহমান মিয়া সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘জুলাইয়ের শেষ থেকে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, নেট না থাকা ও আগস্টে কিছু দিন নিরাপত্তা শঙ্কা নিয়ে আমাদের কাজ কম হয়েছে। ব্যাক লগগুলো ক্লিয়ার করার জন্য আমাদের টানতে হচ্ছে। আমাদের সবাইকে কমিশনার স্যার বলেছেন, স্টেকহোল্ডারদের কোনো হয়রানি না হয় মতো দ্রুততার সঙ্গে সব কাজ শেষ করতে। আমরা সবাই এ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। তাই গতি বেড়েছে।’
গতি বাড়লে আয়ও বাড়ার কথা উল্লেখ করে কাস্টম হাউসের বাড়তি আয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছি। এজন্য রাজস্ব খুব একটা বেশি হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। আমাদের রাজস্ব আয়ের জন্য আমদানি বাড়াতে হয়। এখন কৃষি ও নিত্য পণ্য বেশি আসছে। বিলাসী পণ্য বা যেসব পণ্যে ট্যাক্স বেশি, সেগুলো এলসি জটিলতায় আমদানি হচ্ছে না। তাই রাজস্বে উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে না।’