চট্টগ্রাম

‘গাঁজা দিয়ে’ প্লাস্টিক কারখানার মালিক-শ্রমিককে ফাঁসানোর অভিযোগ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্ন কর্মীর কাজ করেন আনোয়ার হোসেন ও মো. শিপন। দু’জন সম্পর্কে ভাই। থাকেন নগরীর বাকলিয়ার নতুন ব্রীজ এলাকার বিসিএস হাউজিং সোসাইটির এ ব্লকে। গত ১ মার্চ রাত ৮টায় চাকরিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আনোয়ার হোসেন। এমন সময় দুই পুলিশ সদস্য তার দরজায় কড়া নাড়েন। এরপর আনোয়ার ও শিপনকে নিয়ে যান পাশের একতা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে। সেখানে তাদেরকে একটি ফরমে সই করার জন্য বলা হয়। এতে অপারগতা প্রকাশ করেন দুই ভাই।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদেরকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর দেখি দুটি বস্তা ভর্তি গাঁজা। একটিতে অর্ধেক, অপরটিতে ভরা। তখন একতা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির ফোরম্যান আরিফকে মারধর করছেন পুলিশ সদস্যরা। এ সময় বাকলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আমির হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। আমি যখন পুলিশকে বলি, আমরা এ ঘটনার কিছুই জানি না। আমরা কেন সাক্ষী হিসেবে সই করবো? এ কথার জবাবে এক পুলিশ সদস্য বলে, এই ব্যাটা তোদের কোনো সমস্যা হবে না। শুধু বলবি, এই মালগুলো আরিফের কাছে পাওয়া গেছে।’

ঘটনার শুরু যেভাবে

বাকলিয়া থানাধীন নতুন ব্রীজ এলাকার বিসিএস হাউজিং সোসাইটির এ ব্লকে ‘একতা প্লাস্টিক’ নামের একটি ফ্যাক্টরি রয়েছে। এটির মালিক বাঁশখালীর বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল নোমান। অভিযোগ আছে, নোমানের ব্যবসায়িক সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে আশেপাশের প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মালিকরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করেন।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে সিভিল পোশাকে একতা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে যান বাকলিয়া থানার এসআই আমির হোসেন। অভিযোগ আছে, এসময় আমির হোসেন একতা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মালিক নোমানকে বলেন, ‘এখানে ব্যবসা করতে হলে আমাকে প্রতি মাসে চাঁদা দিতে হবে। অন্যথায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

সেদিন এসআই আমির হোসেনের অবস্থানের দৃশ্য নিজের মুঠোফোনে ধারণ করেন একতা প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক মো. বোরহান ওরফে আরিফ। ভিডিও করার বিষয়টি আমির হোসেনের নজরে আসলে তিনি নমনীয় হয়ে যান; ওই ঘটনার ১১ মিনিট ২ সেকেন্ডের তিনটি পৃথক ভিডিও ফুটেজ হাতে এসেছে।

অভিযোগ আছে, সেদিন ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় আমির হোসেন বলেন, ‘যেকোনো উপায়ে একতা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মালিক নোমানকে তিনি দেখে নিবেন। এটার খেসারত সারাজীবন দিতে হবে।’

যেই কথা সেই কাজ?

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সিভিল পোশাকে একতা প্লাস্টিক কারখানায় অবস্থান করেন আমির হোসেনসহ ৪ জন পুলিশ সদস্য। উপস্থিত হওয়ার পর বলতে থাকেন, ‘এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে?’ ‘না’ বলার পরপরই কারখানার ফোরম্যান আরিফকে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। লোডশেডিং থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ‘এই কাজ কতদিন থেকে করিস’ বলে তাঁকে মারধর শুরু করেন। প্রথম ধাপে সিভিল পোশাকে ৪ জন পুলিশ আসার আনুমানিক আধা ঘণ্টা পর পুলিশ ভ্যানে করে আরও ৪ জন পুলিশ আসে বলেও জানান ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জামশেদ হোসেন বলেন, ‘নতুন ব্রীজের নবাবীয়া রেস্টুরেন্টের সামনে আমার একটি পানের দোকান আছে। সন্ধ্যায় দোকান করা শেষে আমি বাসায় যাই রান্না করার জন্য। তখন ৪ জন পুলিশ আমার দরজায় কড়া নেড়ে বলে, এখানে কে আছেন? তখন আমি দরজা খুলতেই বলে, এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে? আমি বললাম সিসি ক্যামেরা নেই। তখন আরিফ নামের ছেলেটা ছাগল বাঁধছিল। ছাগল দুটি তার নিজের। তখন তার কাছে গিয়ে ৪ পুলিশ সদস্য দুটি বস্তা নিয়ে বলে, এগুলো কতদিন থেকে করিস? এই বলে তাকে মারধর শুরু করে।’

একতা প্লাস্টিকের মালিককে আসামি করে মাদক আইনে মামলা

১ মার্চ রাতে একতা প্লাস্টিক কারখানার মালিক আবদুল্লাহ আল নোমান (৩০) ও ফোরম্যান মো. বোরহান প্রকাশ আরিফকে (২৬) আসামি করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বাকলিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন এসআই আমির হোসেন। এতে আবদুল্লাহ আল নোমানকে পলাতক দেখানো হয়৷

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, “বাকলিয়া থানার সাধারণ ডায়েরি নং-৩৫, ০১/০৩/২০২৪ মূলে আমি সঙ্গীয় ফোর্সসহ বাকলিয়া থানা এলাকায় অভিযান ডিউটি করাকালে ৭ টা ৪৫ মিনিটের সময় নতুন ব্রীজ এলাকায় বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি, বাকলিয়া থানাধীন নতুন ব্রীজস্থ কর্ণফুলী বিসিএস হাউজিং সোসাইটি এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা মাদকদ্রব্য গাঁজা ক্রয় ও বিক্রয়ের জন্য অবস্থান করছে। প্রাপ্ত সংবাদটি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে বাকলিয়া থানাধীন নতুন ব্রীজস্থ বিসিএস হাউজিং সোসাইটির এ ব্লকের ৩নং রোডের ১৯ নং প্লটের উত্তর-পূর্ব কোণে পৌঁছলে একজন লোক পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ফ্যাক্টরি থেকে পালানোর চেষ্টাকালে অফিসার ফোর্সের সহযোগিতায় ধৃত করি। তাকে পালানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে এলোমেলো কথা বলে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তার নাম মো. বোরহান প্রকাশ আরিফ (২৬) এবং তার হেফাজতে মাদকদ্রব্য গাঁজা আছে বলে স্বীকার করে।”

এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, “আরিফের দেখানো ও শনাক্ত মতে পলাতক আসামি আবদুল্লাহ আল নোমানের পরিচালনাধীন একতা প্লাস্টিক কারখানার ভেতর উত্তর-পূর্ব কোণ হতে ধৃত আসামির নিজ হাতে বের করে একটি হলুদ রংয়ের প্লাস্টিকের বস্তার ভেতর রক্ষিত ৪ পোটলা ও কালো রংয়ের পলিথিন দ্বারা মোড়ানো অবস্থায় তিন পোটলা গাঁজা পাওয়া গেছে। প্রতিটি পোটলায় ২ কেজি করে মোট ৬ কেজি গাঁজা এবং অপর নীল রংয়ের পলিথিন দ্বারা মোড়ানো পোটলায় এক কেজি সহ মোট ৭ কেজি গাঁজা পাওয়া যায়। যার আনুমানিক মূল্য ৭০ হাজার টাকা।” এসব গাঁজা পাইকারি বিক্রি করার জন্য রাখা হয় বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

মামলার সাক্ষীরা কী বলছেন

এ ঘটনায় আনোয়ার হোসেন ও মো. শিপন নামের দুই সহোদরকে সাক্ষী করা হয়েছে। তবে আনোয়ার ও শিপনের দাবি, তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক সই আদায় করা হয়েছে।

সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমি তখন ঘুমে ছিলাম। আমার ভাই শিপন ভেতরের রুমে ছিল। আমার ছোট মেয়ে আমাকে ডেকে বলতেছে, ‘আব্বু পুলিশ আসছে?’ তখন আমার মেয়েকে বললাম, ‘পুলিশ আসছে তো কী হয়েছে?’ কিছুক্ষণ পর আমি আমার মোটরসাইকেল নিয়ে চাকরিতে যাবো, এমন সময় পুলিশ আমাকে দাঁড় করিয়ে বলে, কোথায় যাও? আমি বললাম, ‘স্যার আমি সিটি করপোরেশনে চাকরি করি। ওখানে যাচ্ছি।’ তখন পুলিশ বললো, ‘দাঁড়াও তোমার কাজ আছে।’ কাজ আছে বলে আমাদেরকে ফ্যাক্টরির ভেতরে নিয়ে যায়। তখন আমাকে বলে, ‘এখানে একটা সিগনেচার দাও।’ আমি সিগনেচার দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এগুলো দেখছো? আমি বললাম, ‘এগুলো তো আমি চিনি না।’ তখন তিনি বললেন, ‘এগুলো গাঁজা। এখানে পাওয়া গেছে।’ তখন আমি বললাম, ‘আমি দেখি নাই। আমি কিছু জানি না। আমি সিগনেচারও দিতে পারবো না। তখন গাঁজাগুলো আমাদের বাসার সামনে এনে রাখছে। আমাদেরকে বারবার ধমকাচ্ছে। আমার ভাই আর আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক সিগনেচার নিলো।”

আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, “তখন পুলিশের একটা গাড়ি মেইন রোডে পার্কিং করে রাখা হয়। আমরা দুই ভাইকে গলি থেকে কোথাও যেতে দেয়নি।”

অপর সাক্ষী মো. শিপন বলেন, ‘আমাদের বাসার সামনে এসে বলে যে, এটা কীসের বাসা? আমি বলি এটা ফ্যামিলি বাসা। পরে বলে তোমরা কী কাজ কর? আমরা বললাম, সিটি করপোরেশনে কাজ করি। তখন ওরা আমাদের ডেকে নিয়ে গেল। আমার ভাই প্রতিদিন ৮-৯টার দিকে কাজে যায়। কাজে যাওয়ার সময় আমার ভাইকে থামিয়ে বলে তাদের সাথে যেতে হবে। আমাদের নাকি কাজ আছে সেখানে। যাওয়ার পর আমাদের কাছ থেকে সিগনেচার নিলো। নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার নিল। আমরা এই জায়গায় তিন বছর ধরে থাকি। কখনো আরিফকে খারাপ কাজ করতে দেখিনি। কী করবো ভাই আমাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক সিগনেচার নিল। আমার ভাবি যখন আরিফকে মারধর করার সময় কান্না করতেছে, তখন পুলিশ একটা বলতেছে, আরিফ তোর জামাই লাগে নাকি? কাঁদতেছিস কেন?’

এ ঘটনায় তিন নম্বর সাক্ষী করা হয়েছে বাকলিয়া থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ফিরোজ আলী। এ বিষয়ে জানার জন্য ফিরোজ আলীকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

একতা প্লাস্টিক কারখানার মালিক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘মূলত আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এসআই আমির হোসেন আমাকে বলেছিল, এমন শায়েস্তা করবে, যার খেসারত সারাজীবন দিতে হবে। আমার প্লাস্টিক কারখানার মূল মিস্ত্রি আরিফ। আরিফ ২১ ফেব্রুয়ারি ভিডিও করেছিল। তাই সে-ও টার্গেটে ছিল। আমি সব কিছু তুলে ধরে আজ রোববার পুলিশ কমিশনার মহোদয় বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি এসআই আমির হোসেনের বিরুদ্ধে।’

জব্দ তালিকার সাথে ঘটনার গরমিল!

একটি হলুদ রংয়ের প্লাস্টিকের বস্তা ও আরেকটি কালো রংয়ের পলিথিন মোড়ানো অবস্থায় এবং আরেকটি নীল রংয়ের পলিথিন দ্বারা মোড়ানো অবস্থায় ৭ কেজি গাঁজা উদ্ধার হয়েছে বলে জব্দ তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে মামলার সাক্ষী মো. আনোয়ার হোসেনের দাবি, সেখানে দুটি বস্তা ছিল। একটি আধা বস্তা ও আরেকটি ভরা অবস্থায় দুটি বস্তা সেখানে ছিল। বস্তা দুটির ওজন আনুমানিক ২৪-২৫ কেজি হবে।

অভিযোগের বিষয়ে কী বলছে পুলিশ

গত ২১ ফেব্রুয়ারি একতা প্লাস্টিক কারখানায় যাননি বলে দাবি করেছেন এসআই আমির হোসেন। পরে সেদিনের ভিডিও সংরক্ষিত থাকার প্রসঙ্গ আনা হলে তিনি আমতা আমতা করে বলেন, ‘ওখানে আমি অন্য একটি বিষয় নিয়ে গিয়েছিলাম ভাই।’

অন্য বিষয়টি কি ছিল?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওখানে তাদের বিরুদ্ধে অন্য পার্টি একটি জিডি করেছিল। জিডির তদন্ত করার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তাদেরকে গালিগালাজ করিনি। হুমকিও দেইনি। তাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। এখন তারা অভিযোগ করবেই। মামলা দিলে তারা আপনাকে পছন্দ করবে?’

মামলার সাক্ষীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক সই নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসআই আমির বলেন, ‘আমরা তাদের কাছ থেকে জোর করে সাক্ষর নেইনি। তাদেরকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারা কোর্টে গিয়েই বলবে সত্য না মিথ্যা।’

এসআই আমিরের বক্তব্যের বিষয়ে একতা প্লাস্টিক কারখানার মালিক আবদুল্লাহ নোমান বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের জিডি ছিল না। জিডি থাকলে প্রমাণ দেখাতে বলুন।’ এরপর এই বিষয়ে জানতে এসআই আমির হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাকলিয়া থানার ওসি মো. আফতাব হোসেন বলেন, ‘এ ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। তদন্ত চলমান। সাক্ষীরা তো কত কথা বলবেই।’

এসআই আমির হোসেন সিভিল পোশাকে ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন- এই অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কিছু না বলেই মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন ওসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *