গুমের ঘটনা তদন্তের পথে কমিশন
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন ও গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের অভিযোগগুলোর প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসার পথ তৈরি হয়েছে। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) প্রথম বৈঠকে বসবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানা গেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, শুরুতেই কর্মপরিধির বিষয়ে স্পষ্ট করে মানবাধিকারকর্মী, সংগঠন ও ভুক্তভোগী স্বজনদের সঙ্গে মতবিনিময় জরুরি। ২৩টির বেশি ‘আয়নাঘর’-এর তথ্যপ্রমাণাদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংগ্রহ করা জরুরি।
সরকার গত ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এই কমিশন গঠন করে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে ওই কমিশনকে তদন্ত করে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নুর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস এবং মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন।
কমিশনের কাজের পরিকল্পনা জানতে চাইলে নুর খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বৈঠকে বসবো রবিবার। বেশকিছু প্রস্তাবনা আছে, সবার বিবেচনার জন্য সেটা হাজির করা হবে। যে টার্গেট তার সামান্যও যদি এগোনো যায়, তাহলেই এটাকে সফল বলতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সবসময় দেখা গেছে, তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই গণমাধ্যমে নানা কথা সামনে এসে যায়। আমরা এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে চাই। আশা করছি, তিন মাসের মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে পারবো।’ পূর্বের তদন্ত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত সময়ে ঘটে যাওয়া অনেক গুমের বিষয়ে মাঠে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও তথ্য সংগ্রহ করে রাখা আছে। সেই কাজগুলো কাঠামোগতভাবে হাজির করার কাজটা করতে হবে। আশা করি, ভালো কিছু হবে।’
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামল এবং তারও আগে বিএনপির শাসননামলে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেওয়ার পর লাশ উদ্ধার, বা নিখোঁজের ঘটনাগুলো আলোচনায় ছিল। বিদেশি গণমাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন, গোপন বন্দিশালায় দীর্ঘদিন আটকে রাখার ঘটনা। যদিও কমিশনের কার্যপরিধিতে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছেন, তা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দিন আট বছর পর গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত গোলাম আযমের ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর কাসেম আলীর ছেলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। একই দিনে পাঁচ বছরের বেশি সময় পর গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হন পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা।
গোপন বন্দিশালাগুলোর মধ্যে একটি ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত। গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে আয়নাঘরের মতো অন্যান্য যেসব জায়গায় যারা বন্দি আছেন, তাদের মুক্তি ও গুম করে রাখার জন্য আয়নাঘরের মতো সব ঘর ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে তারা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিও জানিয়েছেন। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে প্রত্যাশা জানতে চাইলে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমিশনের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। তারা এখনও কাজ শুরু করেনি বলেই জানি। তারা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে থেকে কাজটা এগিয়ে নেবেন, বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালেই হয়তো যেতে হবে। কোন প্রক্রিয়ায় হবে সেটি এখনও আমরা জানি না। কমিশন নিশ্চয় তা স্পষ্ট করবে।’
শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গুমের ঘটনায় তদন্তের দাবি জানিয়ে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠন গত ১৮ আগস্ট বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ১৫৮ ব্যক্তির একটি তালিকা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে দিয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরের পর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন ‘এটি আমাদের জন্য বিশেষ করে মানবাধিকার কর্মীদের জন্য একটি বড় মাইলফলক। ৭০০ জনের ওপরে মানুষ এখনও পর্যন্ত গুমের কারণে নিখোঁজ হয়ে আছেন। আর যেন কেউ কখনও নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে কোনও বাহিনীকে দিয়ে কোনও পদ্ধতির মাধ্যমে নাগরিকদের গুম করতে না পারে। এ জন্য এই সনদে স্বাক্ষর করা হয়েছে। এ বিষয়ে এখন প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার গ্রহণ করা হবে।’
জোরপূর্বক গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনকে শুরুতেই বেশকিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে উল্লেখ করে মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ‘‘কমিশন যেটা গঠন করা হয়েছে— তার কার্যপরিধি, কার্যক্রম কতদিন বিস্তৃত হবে, সরকারের কাছে ৪৫ দিনের মধ্যে যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা, সেই সময়টা কতটা সহায়ক, সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। প্রায় সাতশ’র ওপর গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা, তথ্য সংগ্রহ, মামলা করা, এবং একইসঙ্গে অপরাধের সঙ্গে কারা যুক্ত ছিল, তাদের চিহ্নিত করার কাজ আছে। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, যারা সাক্ষী দেবেন তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রদান করার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে কাজ করতে হবে। ২৩টির বেশি ‘আয়না ঘর’ আছে বলে আমরা জানতে পারছি। যেসব জায়গায় আয়না ঘর আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সেখান থেকে তথ্য প্রমাণাদি জোগাড় করতে হবে। এসবই সময়সাপেক্ষ কাজ। এ সময়টা তাদেরকে দিতে হবে।’ লেনিন আরও বলেন, ‘আমাদের মনে প্রশ্ন আছে— কমিশন কি কেবল ঢাকায় কাজ করবে? নাকি তৃণমূল পর্যন্ত তাদের কর্মপরিধি বিস্তৃত হবে? কেননা, নোয়াখালী, ফেনী, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, রংপুরে গুমের ঘটনা ঘটেছে। কমিশনের মাত্র ৫ জন সদস্য মিলে সব জায়গায় কীভাবে পৌঁছাবেন, সেদিকেও খেয়াল করা দরকার। তবে তারা মূল কাজ শুরুর আগেই যে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিয়মিত কাজ করে চলেছেন এবং যারা ভুক্তভোগী, তাদের সঙ্গে একটি মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেওয়াটা জরুরি। আর প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে আয়না ঘরে ছিলেন, অবশ্যই এমন ভুক্তভোগী ও নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।’