চাঁদাবাজিতে সিদ্ধহস্ত মামুন এবার শ্রীঘরে
নাম তার মোহাম্মদ উল্লাহ আল মামুন। বাড়ি খুলশী থানার পাহাড়তলী এলাকার ফয়’স লেকের লেকভিউ হাউজিং আবাসিকে। নিজেকে পরিচয় দেন স্থানীয় ‘কাউন্সিলরের লোক’ হিসেবে। মাদক থেকে শুরু করে এমন কোনো কারবার নেই যেখান থেকে তিনি পকেট ভরেন না! মারামারি-চাঁদাবাজিতেও একেবারে সিদ্ধহস্ত। এলাকায় ঘুরে ঘুরে চাঁদাবাজির নানা ফন্দি আঁটেন। আর চাঁদা না পেলেই নিজের ক্যাডার বাহিনী লেলিয়ে দেন।
শুধু তাই নয়, কাজ করেন কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্ট অ্যামিউজমেন্ট নামে একটি পার্কের ‘পেইড ক্যাডার’ হিসেবেও। পার্কের হয়ে ‘কব্জির জোর’ দেখিয়ে জিএমের সাথেও গড়েছেন দহরম-মহরম সম্পর্ক। আর কনকর্ড গ্রুপের ভবনগুলোয় পেয়ে গেছেন অবৈধ কারবারের ‘লাইসেন্স’।
সবশেষ, একইভাবে খুলশী ক্লাবের কাছ থেকেও চাঁদাবাজির ফন্দি এঁটেছিলেন একাধিক মামলার আসামি সন্ত্রাসী মামুন। তবে, পূরণ হয়নি তার সেই খায়েশ। এবার মামলা খেয়ে যেতে হয়েছে শ্রীঘরে।
বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) চট্টগ্রাম ৫ম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক বেগম নুসরাত জাহান জিনিয়া জামিন না মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মারধর এবং হত্যা চেষ্টার অভিযোগ এনে মামুনসহ মোট ৫ জনকে আসামি করে খুলশী ক্লাবের সহসভাপতি মোহাম্মদ রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় মামুনকে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
মামুনকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি বাদীর আইনজীবী ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল সিভয়েস২৪-কে নিশ্চিত করেছেন।
মোহাম্মদ উল্ল্যাহ আল মামুন (৩৮) নগরের খুলশী থানার পাহাড়তলী লেকভিউ হাইজিং আবাসিক এলাকার আবদুল লতিফ মোল্লার ছেলে। মামলার বাকি আসামিরা হলেন, কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্ট অ্যামিউজমেন্ট পার্কের জিএম (অপারেশন) মেজর (অব.) এনামল করিম (৫৮), জিএম (এডমিন) মো. তুহিন (৩৫), মহিউদ্দিন সাজ্জাদ (৪২) ও মোহাম্মদ হাসান (২৬)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসামি মোহাম্মদ উল্লাহ আল মামুন খুলশীর ফয়’স লেকে থাকা একটি রিসোর্টের মালিক। যেখানে পতিতাবৃত্তি সহ নানা অপকর্ম করান তিনি। এছাড়া হোটেলে যাওয়া যুবক-যুবতিদের জিম্মি করে টাকাও আদায় করেন। ভূমি দখলের সাথেও জড়িত এই ‘ক্যাডার’ মামুন। মূলত ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর নাম ভাঙিয়ে তিনি এসব অপকর্ম করে বেড়ান।
তবে, মোহাম্মদ উল্ল্যাহ আল মামুন নামে কাউকে চেনেন না বলে জানিয়েছেন ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘এই নামে কেউ আমার সাথে রাজনীতি করে না। আর আমি চিনিও না।’ কাউন্সিলরের নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে থাকলে তাকে ধরে পুলিশে দিতে এলাকাবাসীকে অনুরোধ করেন ওয়াসিম।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, খুলশী থানার ফয়’স লেকে নিজস্ব জায়গায় গড়ে তোলা খুলশী ক্লাবের দুটি প্রবেশপথের মধ্যে ১ নম্বর গেইট ক্লাবের সদস্যদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি ক্লাব কমপ্লেক্সের উন্নয়ন কাজের নির্মাণ সামগ্রী আনা নেওয়ার জন্য এবং সদস্যদের গাড়ি চলাচলে ক্লাবের দ্বিতীয় গেইট ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ওই রাস্তায় বাংলাদেশ রেলওয়ের ভাড়াটিয়া দাবি করে কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্ট এ্যামিউজমেন্ট পার্ক কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেয়।
এ বিষয়ে খুলশী ক্লাব কর্তৃপক্ষ রেলওয়ের জিএম (পূর্ব) এর সাথে আলোচনা করলে তিনি সরেজমিন তদন্ত করে জায়গার ড্রয়িং ম্যাপ জমা দিতে বলেন। এরই মধ্যে পার্কের জিএম-এর নির্দেশে বাকি আসামিরা স্থানীয় সন্ত্রাসী নিয়ে দেয়াল তুলে ক্লাবের দ্বিতীয় গেইট পুরোপুরি বন্ধ করার চেষ্টা করে। বিষয়টি সিটি করপোরেশনকে অবহিত করা হলে ৩১ জানুয়ারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা গিয়ে রাস্তা বন্ধের কার্যক্রম স্থগিত করেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে পার্ক কর্তৃপক্ষ আবারও চসিকের ফুটপাত এবং রেলিং ভেঙে ঢালাই করার উদ্যোগ নিলে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি চসিক ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি জানান। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট পৌঁছানোর আগেই পার্কের জিএমের নির্দেশে মামুনসহ বাকি আসামিরা বাদীকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। এ সময় বাদী নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসাবে পরিচয় দিলেও আসামি মামুন গালাগালি করতে করতে বাকি আসামিদের সাথে নিয়ে বাদীকে কিল-ঘুষি মারতে থাকেন।
একপর্যায়ে বাদীকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসামিরা পার্কের অফিসের ভেতরে নিয়ে যান। সেখানে নিয়েও নির্যাতন করা হয় বাদী রফিক উদ্দিন ভুঁইয়াকে। এ সময় নির্মাণশ্রমিকদের দেওয়ার জন্য তার কোটের পকেটে থাকা দুই লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় আসামিরা। ম্যাজিস্ট্রেট আসার খবরে এক সপ্তাহের ভেতরে ১০ লাখ টাকা না দিলে ক্লাবের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দিবে বলে হুমকি দিয়ে বাদীকে তালাবদ্ধ করে চলে যায় আসামি মামুন।
বাদীকে খোঁজাখুঁজির পরেও না পেয়ে খুলশী ক্লাবের সদস্য কাজী সুজাউদ্দিন আহমেদ ৯৯৯-এ ফোন করলে খুলশী থানার পুলিশ ফোর্স ঘটনাস্থলে আসে এবং চসিক ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে থাকা পুলিশ ফোর্সসহ গিয়ে বাদীকে তালাবদ্ধ রুম থেকে উদ্ধার করে।
এদিকে মামুনের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় চাঁদাবাজি, মারামারি এবং মাদক আইনে একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে খুলশী থানায় ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি একটি মারামারির মামলা (মামলা নম্বর: ১৭/২২), একই বছরের ৪ জুলাই (মামলা নম্বর : ২৫১/২২) ও ৬ এপ্রিল (১৬/১৪০) এবং ২০১৬ সালের ১ মে (মামলা নম্বর: ১০৯/১৬)সহ চারটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় মূল অভিযুক্ত মামুন।