চোরাচালানের প্রভাবে বহুমুখী সংকটে জুয়েলারি শিল্প
বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ৯২৫ দশমিক ৯১৯ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে। এ সময়ে চোরাচালানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে ২৯০ জন। মামলা হয়েছে ২৮৯টি। তবে পরবর্তীতে গ্রেপ্তার ব্যক্তি ও মামলার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এতে জিম্মি হয়ে পড়ছে দেশের সোনার পাইকারি বাজার। একইসঙ্গে বাড়ছে সোনার দাম, অন্যদিকে বহুমুখী সংকটে পড়েছে দেশের জুয়েলারি শিল্প।
সোমবার (৩ জুন) সকালে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ জুয়েলারি এসোসিয়েশন (বাজুস) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
‘সোনা ও ডায়মন্ড চোরাচালান বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলন লিখিত বক্তব্য দেন এসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সহসভাপতি ও বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এন্টি-স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের চেয়ারম্যান রিপনুল হাসান।
রিপনুল হাসান বলেন, “২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ৯২৫ দশমিক ৯১৯ কেজি চোরাচালানের সোনা জব্দ করা হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত অঞ্চলগুলো থেকে ২৭ দশমিক ৭১৩ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। এছাড়াও ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ কর্তৃক গ্রেপ্তার আসামির সংখ্যা ২৯০ জন এবং দায়ের করা মামলার সংখ্যা ২৮৯টি। শুধু তাই নয়, গত ১০ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউস, বিজিবি, পুলিশ ও এয়ারপোর্ট এপিবিএন সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করেছে। তবে গ্রেপ্তার করা হলেও পরবর্তীতে তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও বলেন, ভারতের গুজরাটের সুরাটে বিশ্বের ৬৫ শতাংশের বেশি হীরা কাটিং ও পলিশিং করা হয়। খুব সহজে হীরা বহন করা যায়। তাই অনেকেই ধারণা করেন, দেশটি থেকে অবৈধভাবে হীরা এ দেশে আসছে। কাস্টমসের তথ্য বলছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শিল্পে ব্যবহারের জন্য ৪টি চালানে মোট ২ কেজি ১৬০ গ্রাম হীরা আমদানি করা হয়েছে। এছাড়াও বিগত ১৯ বছরে যত হীরা আমদানি করা হয়েছে, তার ৮৭ শতাংশই আনা হয়েছে ভারত থেকে। তবে হীরার আমদানি হলেও হীরার অলংকার আমদানি করা না। কিন্তু দেখা গেছে, বিজিবি সদস্যরা ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচারের সময় ২০২১ সালে সাতক্ষীরা সীমান্তে পৌনে দুই কোটি টাকার ১৪৪টি হীরার গয়না জব্দ করেছে। এর আগে হীরার গয়না জব্দ করা হয়েছে ২০১৮ সালে ৭০ লাখ টাকার।”
চোরাচালানের পথ ও এতে জড়িতদের কথা উল্লেখ করে বাজুসের এই সদস্য বলেন, “দেশ সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে অন্যতম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত। গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য বলছে, হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে প্রচুর সোনার বার, সোনার অলংকার ও হীরা খচিত অলংকার দেশে প্রবেশ করে। বিমানে কর্মরত কর্মীদের সম্পর্কিত থাকার কয়েকটি ঘটনায় প্রমাণ রয়েছে। সাধারণত বিমানবন্দর দিয়ে ছাড় হওয়ার পর কর্মীগণ বাস ও ট্রেনযোগে ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা বর্ডার দিয়ে ভারতে পাচার করে। সোনা চোরাকারবারিরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিদেশ থেকে সোনার বার আনছে। গত কয়েক মাসে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে প্রায় ২৬ কেজি চোরাচালানের সোনা জব্দ করা হয়েছে।”
জুয়েলারি শিল্পে চোরাচালানের প্রভাব উল্লেখ করে রিপনুল হাসান বলেছেন, “বন্ড সুবিধা ছাড়া অমসৃণ হীরা আমদানিতে কর ৮৯ শতাংশ। মসৃণ হীরা আমদানিতে কর প্রায় ১৫১ শতাংশ। এই শুল্ককর ফাঁকি দিতেই মূলত অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণে হীরা আসছে। তবে আমরা সোনা চোরাচালানের খবর পেলেও হীরা চোরাচালানের খবর পাওয়া যায় না, যা রহস্যজনক। বেপরোয়া চোরাচালানের ফলে বহুমুখী সঙ্কটে পড়েছে দেশের জুয়েলারি শিল্প। দেশে খোলাবাজারে মার্কিন ডলারের দাম প্রায় ১২০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সোনার বাজারে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিয়েছে চোরাকারবারিদের দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট। তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিনিয়ত স্থানীয় পোদ্দার বা বুলিয়ন বাজারে সোনার দাম বাড়াচ্ছে। পোদ্দারদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সোনার পাইকারি বাজার।”
চোরাচালান বন্ধে সুপারিশ করে সংগঠনটির এই সদস্য বলেছেন, “সোনা ও হীরা চোরাচালানে জড়িতদের ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরালো অভিযান পরিচালনা করা জরুরি। সোনা ও হীরা চোরাচালান প্রতিরোধে বাজুসকে সম্পৃক্ত করে পৃথকভাবে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন করে ব্যাগেজ রুল সংশোধনের মাধ্যমে সোনার বার আনা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি মট্যাক্স ফ্রি সোনার অলংকারের ক্ষেত্রে ১০০ গ্রামের পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৫০ গ্রাম করতে হবে। এছাড়াও একই ধরনের অলংকার দুটির বেশি আনা এবং একই সঙ্গে একজন যাত্রীকে বছরে শুধুমাত্র একবার ব্যাগেজ রুলের সুবিধা নেওয়ার বিধান তৈরি করতে হবে। ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার ও অলংকার আনার সুবিধা অপব্যবহারের কারণে ডলার সঙ্কট ও চোরাচালানে কী প্রভাব পড়ছে, তা জানতে বাজুসকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরকে সমীক্ষা পরিচালনার করারও প্রস্তাব করছি আমরা। আমরা বিশ্বাস করি,আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সুগভীর তদন্তই পারে সোনা ও হীরা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচন করতে।”
উল্লেখ্য, সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলে আরও বাজুসের উপদেষ্টা রুহুল আমিন রাসেল, কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান, সদস্য আনোয়ার হোসেন, ইকবাল উদ্দিন, আলী হোসেন, বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এন্টি-স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের সদস্য শাওন সাহা প্রমুখ।