চট্টগ্রাম

টাকা হাতান ভাবি, বাঁচান সিআইডি দেবর!

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার কসমোপলিটন এলাকার ৫ নম্বর সড়কের ৩৮ নম্বর বাড়ি। সেখানে পাঁচটি ফ্ল্যাট আছে শামীমা নার্গিসের স্বামী মফিজ উদ্দিন আহমেদের।ফ্ল্যাটগুলো তিনি পালাক্রমে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বন্ধক দেন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে। টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটে ওঠার দুই মাস পর সেখানে হাজির হন শামীমা নার্গিসের দেবর জাহাঙ্গীর উদ্দিন আহমেদ। যিনি চট্টগ্রামে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কর্মরত। নিজেকে ফ্ল্যাটের মালিক দাবি করে বের করে দেন বাসিন্দাদের। অভিযোগ কিংবা মামলা—কোনোকিছুতেই প্রতিকার পান না ভুক্তভোগীরা। সবখানেই নিজের ক্ষমতা খাটান জাহাঙ্গীর।

পাঁচলাইশ থানার কসমোপলিটন এলাকার বাসিন্দা আলোক বিকাশ বড়ুয়া এমনই অভিযোগ নিয়ে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজের কাছে।

নগরের দামপাড়ায় সিএমপি সম্মেলনকক্ষে ‘ওপেন হাউজ ডে’ অনুষ্ঠানে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত আলোক বড়ুয়ার অনেকের নানা অভিযোগ ও সমস্যার কথা শোনেন পুলিশ কমিশনার। সিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে এমন আয়োজনও এবারই প্রথম।

আলোক বিকাশ বড়ুয়া সিএমপি কমিশনারের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘কসমোপলিটন আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর সড়কের ৩৮ নম্বর বাড়িতে শামিমা নার্গিস নামে একজন নারী থাকেন। সেখানে তার পাঁচটি ফ্ল্যাট আছে। উনি বিভিন্ন ভুয়া দলিল দিয়ে চুক্তি করে ফ্ল্যাট বন্ধকের নামে টাকা নেন। টাকা নেওয়া হলে দুই মাস পর তার দেবর চট্টগ্রামের সিআইডিতে কর্মরত ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর উদ্দিন আহমেদ এসে তার ফ্ল্যাট বলে দাবি করেন। দলিল তুলে দেখা যায় তার নাম নেই। নাম আছে শামীমা নার্গিসের স্বামী এবং জাহাঙ্গীরের বড় ভাই মফিজ উদ্দিন আহমেদের।

আলোক বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা জিডিসহ চেকের মামলা করেছি। আমরা আইনগত যত ব্যবস্থাতেই যাই সিআইডির জাহাঙ্গীর তার প্রভাব খাটিয়ে তার ভাই এবং তার নাম বাদ দেন। কারও ২৫ লাখ, কারও ১২ লাখ আবার আমার ১৫ লাখ ৯৫ হাজার—এরকম আরও অনেক আছে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। জাহাঙ্গীর যেহেতু সিআইডিতে কর্মরত তাই তিনি সবসময় প্রভাব খাটিয়ে মামলার তদন্ত রিপোর্ট প্রভাবিত করেন। তাই কোনো প্রতিকারও পাচ্ছি না। আমার মূল অভিযোগ সিআইডির জাহাঙ্গীর যেন আমাদের মামলাকে প্রভাবিত করতে না পারে।’

অভিযোগ শুনে সিএমপি কমিশনার এ বিষয়ে নগর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্টের (এসএস) কাছে লিখিতভাবে রিপোর্ট পাঠানোর আশ্বাস দেন।

এদিকে, নগরের চান্দগাঁওয়ের বাসিন্দা সত্তর বছর বয়সী মো. ইদ্রিসও গুটি গুটি পায়ে গিয়েছিলেন নিজের অভিযোগ জানাতে। জানালেন—তার মেয়ের স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে পাঁচ বছর পেরিয়েছে। এখন পর্যন্ত তার মেয়ে কাবিননামার প্রাপ্য টাকা বুঝে পাননি। এ নিয়ে তিনি মামলা করলেও তার মেয়ের স্বামী প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।

সিএমপি কমিশনার তার অভিযোগ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আফতাব উদ্দিনকে। কাবিননামার টাকা বুঝে পেতে মো. ইদ্রিসকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।

মঙ্গলবার রাতে মো. ইদ্রিস মুঠোফোনে সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘কখনো ভাবিনি এরকম সরাসরি এসে কমিশনার স্যারের মতো মানুষের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবো। এখন আমি কমিশনার স্যারের নির্দেশে চান্দগাঁও থানায় এসেছি। আমার মেয়ের প্রতি অন্যায় হয়েছে। মেয়ের সাবেক স্বামী জাহিদুল ইসলামের পরিবার প্রভাবশালী হওয়ায় দীর্ঘ পাঁচ বছর আইনি লড়াই করেও প্রতিকার পাইনি। এখন যদি এটির সমাধান হয়, আমার মেয়ে ন্যায্যতা পায় তবে আমি কমিশনারের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক অনেক দোয়া করবো।’

ওপেন হাউজ ডে’তে মঙ্গলবার মোট ৮৪ জন ব্যক্তি তাদের অভিযোগ সরাসরি জানিয়েছেন সিএমপি কমিশনারকে। এর মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান পেয়েছেন ৩২ জন। তাদেরই একজন ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তানভীর শাহরিয়ার।

অভিযোগ তুলে ধরে এই ছাত্র বলেন, ‘আমরা ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে আমাদের বাসার জমিদার বাসা ছেড়ে দিতে প্রেশার দিচ্ছেন। বাড়ির মালিক আওয়ামী লীগের নেতা এবং ১৬ জুলাই ছাত্র হত্যা মামলার একজন আসামিও। বর্তমানে তিনি পলাতক থাকলেও তার বোন আমাদের চাপ দিচ্ছেন বাসা ছাড়ার জন্য।’

পরে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ ৬ মাসের আগে যেন ওই ছাত্রকে বাড়ি ছাড়ার জন্য চাপ প্রয়োগ না করা হয়, সে সংক্রান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।

ওই অনুষ্ঠানে আসা সেবাপ্রার্থীর অনেকে নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, অবৈধ ভাসমান দোকান, কিশোর গ্যাং সমস্যাসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ তাদের সব অভিযোগ শুনে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

ওপেন হাউজ ডে-তে আরও উপস্থিত ছিলেন সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) আ স ম মাহাতাব উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) আবদুল মান্নান মিয়া, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহাম্মদ, উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) এস এম মোস্তাইন হোসেন, উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) রইছ উদ্দিন প্রমুখ।

প্রসঙ্গত, চলতি সপ্তাহ থেকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার তাঁর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘ওপেন হাউজ ডে’ আয়োজনের মাধ্যমে নগরবাসীর বিভিন্ন সমস্যা ও অভিযোগ শুনে তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। যা প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে। আজ মঙ্গলবার ছিল প্রথম ‘ওপেন হাউজ ডে’।

এছাড়া নগরের ১৬ থানার ৪ জোন অর্থাৎ বন্দর, পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) কার্যালয়ে প্রতি রবিবার একই প্রক্রিয়ায় সাধারণ জনগণের বক্তব্য শুনবেন ডিসিরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *