জাতীয়

টিএসসিতে গণত্রাণ কর্মসূচি, সমন্বয়হীনতায় নানা প্রশ্ন

বন্যার্তদের জন্য গণ ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনায় সমন্বয়হীনতার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসছে। কর্মসূচির সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নানা প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।

বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা দিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) চলছে কর্মযজ্ঞ। শুরু থেকে দেখা গেছে, ত্রাণ দেওয়া মানুষের উপচে পড়া ভিড়। শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগে অংশ নিতে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নগদ অর্থ কিংবা ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দিতে আসেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। সেখানে দেখা যায়, ৭ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ এসেছেন বন্যাকবলিত মানুষের জন্য বস্তাভর্তি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। অর্থ সংগ্রহ এবং ত্রাণসামগ্রী বিতরণের হিসাবও জানিয়েছিলেন দায়িত্বশীলরা। ছয় দিনে ৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ সংগ্রহ হয়েছে। তবে কয়েক দিন যেতে না যেতে, সন্দেহ এবং প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ত্রাণ নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আচরণ, টাকার স্বচ্ছ হিসাব না রাখাসহ বিস্তর অভিযোগ আসতে থাকে। এ ছাড়া ত্রাণসামগ্রী সুষ্ঠুভাবে বণ্টন হচ্ছে না বলেও জানান অনেকে। এসব নিয়ে টিএসসিতে নিজেদের মধ্যে হট্টগোলও দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও স্বেচ্ছাসেবকরা নানান অভিযোগের কথা জানাচ্ছেন। তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সমন্বয়করা।

ত্রাণ কার্যক্রমে শুরু থেকে জড়িত থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোবায়ের আহমেদ বলেন, ‘জানানো হয়েছে, পরিবহন খাতে একটি বড় অংশের অর্থ চলে যাচ্ছে। এদিকে আমার জানামতে, অধিকাংশ ট্রাক বিভিন্ন কোম্পানি ফ্রিতে দিয়েছে। আমি নিজেও শুক্রবার রাতে ১০টি ট্রাক ম্যানেজ করে দিতে চেয়েছিলাম, তখন আমাকে জানানো হয় যে, তাদের ট্রাক লাগবে না, পর্যাপ্ত ট্রাক হাতে আছে, বিভিন্ন কোম্পানি ট্রাক দিচ্ছে। তাহলে এখন পরিবহনের নামে মানুষের ত্রাণের টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে?’

তারা স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা দেখতে চান জানিয়ে জোবায়ের বলেন, ‘যদি ট্রাকের ভাড়া বাবদ টাকা যায় তাহলে সেসব ভাড়ার রসিদ ও ড্রাইভারদের ফোন নম্বর আমরা দেখতে চাই। একই সঙ্গে কোন ট্রাক কোন এলাকায় কবে গিয়েছে সেটাও স্পষ্টভাবে জানতে চাই। ত্রাণের টাকা হেরফের হওয়ার অনেকগুলো অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তাই দুই লাইনের পোস্ট করে টাকার হিসাব দেওয়া এখন আর যথেষ্ট না। টাকাগুলো কোন কোন খাতে খরচ হচ্ছে সেটা জানাও আমাদের অধিকার।’

টিএসসির কার্যক্রমে উপস্থিত থাকা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক জানান, যখন কোনো কারণে টাকা প্রয়োজন হয়, ক্যাশে এসে বললেই ৫০ হাজার, ১ লাখ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে নোট টুকে রেখে। কে কোথায় কোন কাজে খরচ করছে এটার জবাবদিহিতা দরকার। অনেকে ত্রাণ নিতে এসে খালি ট্রাক নিয়ে ফিরে গেছেন, এলাকায় গিয়ে ত্রাণসামগ্রী না দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার অন্য এলাকায় নিয়ে গেছে। একই এলাকায় বারবার ত্রাণসামগ্রী যাচ্ছে, কিছু এলাকায় একেবারেই যাচ্ছে না। ৬-৭ কোটি টাকার যে তহবিল গঠন হয়েছে, তার ব্যবহার কিংবা খরচের যথাযথ হিসাব রাখা ও প্রকাশ না করার অভিযোগও আছে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আসছে স্বেচ্ছাসেবীদের নামে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বেচ্ছাসেবক জানিয়েছেন, নিজ খরচে ট্রাক নিয়ে যাওয়ার পরও তাকে কোনো ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়নি। অনেক জায়গা আছে ত্রাণসামগ্রী এখনো পৌঁছায়নি। মানুষ তাদের বিশ্বাস করে ত্রাণসামগ্রী ও টাকা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যথাযথ বিতরণ হচ্ছে না।

আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সালেহউদ্দিন সিফাত বলেন, ‘বন্যাকবলিত ফেনীতে যারা যারা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়েছেন, তারা সমন্বয়হীনতার বিষয়ে একবাক্যে একমত হবেন। এ ছাড়া টিএসসিতে সমন্বয়ক পরিচয়ে বাজে ও কটুবাক্য ব্যবহারের কথা শোনা যাচ্ছে।’

অভিযোগের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল কাদের ফারহান বলেন, ‘যে অভিযোগগুলো আসছে সেগুলো সঠিক নয়। গত দুদিন আমি নিজেই হিসাব রাখছি। আমরা সবকিছুর যথাযথ হিসাব রাখছি। তবে কেউ খারাপ আচরণ করলে সেটা অনাকাক্সিক্ষত। আমরা ত্রাণসামগ্রী যার-তার হাতে তুলে দিতে পারি না। আমরা সঠিক গাইডলাইন অনুসরণ করে ত্রাণসামগ্রী পাঠাচ্ছি।’

সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘এত বড় একটি কাজে কিছু অব্যবস্থাপনা থাকাও স্বাভাবিক। তবে আমরা বিষয়গুলো নিয়ে দ্রুত বসব। আর আমরা যে টাকা পাচ্ছি তার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রকাশ করব। কেউ যদি অনিয়ম করে তারও বিচার হবে। আমি নিজে অন্যায় করলেও বিচার হবে।’

এদিকে আরেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘সমন্বয়ক কমিটির নামে সারা দেশ জুড়ে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কমিটি থেকে আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে কোনো সমন্বয়ক কমিটি অনুমোদন করা হয়নি। এরপরও দেশব্যাপী সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হচ্ছে। সমন্বয়ক কমিটির নামে চাঁদাবাজি, দখলদারি চলছে। ছাত্র-জনতাকে সম্মিলিতভাবে যেকোনো অন্যায়কে প্রতিহত করতে হবে। যদি কেউ সমন্বয়ক কমিটির নামে খবরদারি করতে আসে তাহলে আপনারা রুখে দাঁড়াবেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *