স্বাস্থ্য

ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু আগস্টে দ্বিগুণ, জনস্বাস্থ্যবিদরা উদ্বিগ্ন

দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যু জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি ডেঙ্গু বৃদ্ধির লক্ষণ দেখাচ্ছে, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিরোধে অকার্যকর। এবার ডেঙ্গু নিয়ে ভয় দুটো কারণে – প্রথমত, এ বছর সংক্রমণ ও মৃত্যু কম হলেও মৃত্যুহার গত বছরের চেয়ে বেশি। দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু সাধারণত বর্ষার অসুখ হলেও বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল অক্টোবরে। বর্তমান আবহাওয়া পরিস্থিতি ডেঙ্গুর অশনিসংকেত দিচ্ছে বলে জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

আগস্ট মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ হাজার, যা জুলাই মাসের ২ হাজার ৬৯৯ জনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। আগস্টে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০ জনের, যা জুলাই মাসের ১২ জনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৩২০ জন, যা শুধু আগস্ট মাসেই প্রায় ৭ হাজার হয়ে গেছে। আগস্ট মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। ১ আগস্ট থেকে শুরু করে পরের চার সপ্তাহে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৬ হাজার ৫১৭, ৭ হাজার ৫৬৩, ৮ হাজার ৯৮০ এবং ১১ হাজার ১৬৫ জনে পৌঁছেছে। আগস্ট মাসের মতো এত বেশি মৃত্যুর ঘটনা আগের কোনো মাসে ঘটেনি।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বড় আকারের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ২০০০ সালে। গত বছর (২০২৩) দেশে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর মাসে সংক্রমণ আগের ২৩ বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের মৃত্যুহার ছিল ০.৫৫%, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ বছর আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও মৃত্যুহার বেড়ে ০.৬৪% হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক এবং বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে ২০১৯ সাল থেকে গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর চার ধরনের মধ্যে ডেন-৩ প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে, গত বছরের জুন মাস থেকে ডেন-২ এর ব্যাপক বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অনেকেই আগে ডেন-৩ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে, পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাদের মৃত্যুঝুঁকি এবং মৃত্যুহার উভয়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন মন্তব্য করেন যে বর্তমানে ডেঙ্গুর চিকিৎসার প্রতি অপেক্ষাকৃত বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে, যদিও তা এখনও পর্যাপ্ত নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ডেঙ্গু শুধুমাত্র চিকিৎসার বিষয় নয়, বরং এটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সহ জনস্বাস্থ্যের জটিল সমস্যাও। তবে, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত হচ্ছে বা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে ডা. রোবেদ আমিনকে নিয়োগ দেয়। কিন্তু তিনি ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্তও যোগ দিতে পারেননি চিকিৎসকদের একটি অংশের বিরোধিতায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, তিনি জানিয়েছেন যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো দিকনির্দেশনা বা উদ্যোগ নেই। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রায় এক মাস ধরে অকার্যকর হয়ে পড়েছে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। একই সময়ে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাঙনের কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জোরদার প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

গত আগস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। ওই দপ্তরের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, গত প্রায় এক দশকে বর্ষা–পরবর্তী সময়ে বৃষ্টি বেড়ে গেছে। আর এর প্রভাব পড়ছে ডেঙ্গুর বিস্তারে।

ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার ঘটে এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে, যা পানিতে জন্ম নেয়। ২০২২ সালে, বর্ষা-পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেখানে ২১,৯৩২ জন আক্রান্ত হয়েছিল। একই বছর, সর্বাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল নভেম্বর মাসে, যেখানে ১১৩ জন মারা গিয়েছিল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, ওই বছর অকালে ডেঙ্গুর বিস্তার, পরবর্তী বছর অস্বাভাবিক হারে ডেঙ্গুর বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসেও বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম মনে করেন, এই বৃষ্টি এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের অভাব, এ বছরও ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

তিনি বলেন, “২০২২ সালের অভিজ্ঞতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বর্ষা-পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা ছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবেলার আর কোনো উপায় নেই।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *