তোফাজ্জলের চুরির বিচার ছাত্রদেরকেই করতে বলেছিলেন ভাবি
মা-বাবা ও ভাইকে হারানোর পর মানসিক ভারসাম্যহীন মাসুদ কামাল তোফাজ্জলের ভাবি শরীফা আক্তারই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। শুধু সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক হওয়ার লোভে সেই ভাবিই তোফাজ্জলের সঙ্গে করেছেন কুকুর বিড়ালের মতো আচরণ।
তোফাজ্জল সুস্থ থাকুক সেটাও কখনও চাননি তিনি। এমনকি মোবাইল চুরির অপবাদের বিচার ছাত্রদেরকেই করতে বলেন ভাবি শরীফা।
এমন সব অভিযোগ লিখে নিহত তোফাজ্জলের মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া তার নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পোস্ট করেন। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং প্রতিটি মানুষের মধ্যে ঘৃণা, ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় ওঠে।
তোফাজ্জলকে মর্মান্তিকভাবে পিটিয়ে হত্যার পর এসব তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পাড়লে বিষয়টি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানান আলোচনা ও সমালোচনার। তানিয়া তালুকদার নামের ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন তোফাজ্জলের মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া।
তানিয়া তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন-
‘তোফাজ্জেল আমার ফুফাতো ভাই ছাড়াও দুধ ভাই (আমরা একই মায়ের দুধ খেয়ে বড় হইছি)। তোফাজ্জলকে যারা মেরে ফেলেছে তারা তো অবশ্যই খুনি! কিন্তু আমার মতে তোফাজ্জলের আর দুজন খুনি অপরাধী নামের খাতা থেকে বাদ পরে গেছে, সেই দুইজন হলো ওর একমাত্র ভাবি এবং ভাইয়ের শাশুড়ি। তোফাজ্জলের পরিবারের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল ওর একমাত্র ভাবি, যে কিনা ওর সঙ্গে কুকুর বিড়ালের মতো আচরণ করতো!! তোফাজ্জল সুস্থ হোক সেটা সে কখনোই চায় নাই, কেন চায় নাই জানেন? কারণ তোফাজ্জল সুস্থ হলে সমস্ত সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে!!’
তিনি তার পোস্টে আরও লেখেন, তোফাজ্জলকে যখন ফজলুল হক হলের ছাত্ররা অত্যাচার করতেছিল, তখন অভাগাটা, নিরুপায় হয়ে ভাবিকেই কল দিতে বলেছিল, হয়তো বা ও ভেবেছিল ভাবির মনটা তার জন্য একটু হলেও কাঁদবে। ওর ভাবি ফোন পেয়ে কি করেছিল জানেন? সে মোবাইল চোরের বিচার ছাত্রদেরকেই করতে বলেছিল এবং এটাও বলেছিল যে, তাকে যেন এ ব্যাপারে আর ফোন দেওয়া না হয়। এই বলে রাতে ফোনটা বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেছিলো!!!
এছাড়াও তানিয়া আরও লেখেন, তোফাজ্জলের মৃত্যুর পরে একমাত্র গার্ডিয়ান হিসেবে দাঁড়িয়েছে ওর একমাত্র ভাবি! সে মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছে, কান্নার অভিনয় করছে, সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা সে নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও নেবে। আমার একটাই প্রশ্ন, সে কোন অধিকারে নিচ্ছে? যে তোফাজ্জল জীবিত অবস্থায় তার থেকে একটু ভালোবাসা পায় নাই, এখন আসছে গার্ডিয়ান হিসেবে। কেন একমাত্র গার্ডিয়ান হিসেবে দাঁড়িয়েছে জানেন? সে এখন তোফাজ্জেল মৃত্যুর বড় একটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পেতে পারে!! ভাবি এইটুকু মাথায় রাখেন, আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না, তোফাজ্জলের এই অবস্থার পিছনে আপনিও দায়ী।
আসমা আক্তারের পোস্ট করা এমন অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করে নিহত তোফাজ্জলের ভাবি শরীফা আক্তার বলেন, তোফাজ্জল বেঁচে থাকলে বলতে পারতো কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। তোফাজ্জল প্রায় তিন চার বছর আমার কাছেই ছিল। যখন কিছুটা সুস্থ ছিল তখন সে বিভিন্ন থানায় রাইটিং এর কাজ করেছে। পারিবারিকভাবে তোফাজ্জলের সঙ্গে আমার কেমন সম্পর্ক ছিল তা মামাতো বোন দূরে বসে কীভাবে দেখবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তোফাজ্জলের বিচার করতে বলেছেন কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কাছে ওই শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনের টাকা দাবি করে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেন তারা। এ সময় আমি তাদের বলি তোফাজ্জল মানসিক রোগী, সে কোনো চোর না তাকে ছেড়ে দিন। এছাড়াও তাদের বলি যদি সে কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে আপনারা আইনের আশ্রয় নেন।
এদিকে জাকিয়া সুলতানা নামের এক নারী তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, আজকে কয়েকদিন ধরে স্বাভাবিক নিয়মে ভাত খেতে পারি না। ভাত খেতে গেলেই কেমন যেন অস্বস্তি হয়। এত মায়াবী চোখ তথাকথিত মেধাবীদের মনে এতটুকুও মায়ার জন্ম দিতে পারেনি। এরা মেধাবী হতে গিয়ে পশুতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। মেধার প্রতিযোগিতায় মনুষ্যত্ববোধ এদের ভেতরে তৈরিই হয়নি কখনো। আমি শুধু ভাবি এদের পরিবারের কথা। কতই না গর্ব করেছিল সন্তান সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে চান্স পেয়েছে বলে। তোফাজ্জল ভাইয়ের তো পৃথিবীতে কাঁদার মতো কেউ নাই। ওনার ফয়সালা তো হাশরের মাঠে হবে। কিন্তু এই মেধাবীদের তৈরি করতে তাদের পরিবারের কত ত্যাগ, শ্রম, কষ্ট সব এক মুহূর্তে যেন বিলীন হয়ে গেল। এতগুলো পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেল এক মুহূর্তেই। আসুন, সন্তানদের মেধাবী হওয়ার আগে মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতা করি। যাতে করে একটা পিঁপড়ে ও পা দিয়ে পিষে ফেলার আগে মনুষ্যত্ববোধ জেগে ওঠে।
উল্লেখ্য, গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটকে রাখেন শিক্ষার্থীরা। পরে কয়েক দফায় তাকে মারধর করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করেন।
