চট্টগ্রাম

দুই নম্বর গেট এলাকার বিষফোঁড়া ড্যান্ডি পার্টি

নগরীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা দুই নম্বর গেট মোড়। হেঁটে বা গাড়িতে এই মোড় পার হতেই চোখে পড়বে একদল শিশু-কিশোর প্রকাশ্যে পলিথিন মুখে লাগিয়ে ড্যান্ডি টানছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টানার পর একপর্যায়ে সড়ক বিভাজক বা সড়কের পাশেই পড়ে থাকছে। সুযোগ পেলে আচমকা ছিনিয়ে নিচ্ছে পথচারীদের মুঠোফোন, ব্যাগ। চলন্ত গাড়ি থেকেও অহরহ চুরি করছে পণ্য। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, এসব গাড়ি থেকে পণ্য চুরি করাই ড্যান্ডি আসক্ত শিশু-কিশোরদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে গেছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) খুলশী ও পাঁচলাইশ থানার সীমান্তবর্তী দুই নম্বর গেট এলাকায় দিনের পর দিন প্রকাশ্যে ড্যান্ডিতে আসক্ত শিশু-কিশোর দলের এই উৎপাত চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এর জন্য আইনি জটিলতাকে দায়ী করছেন পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্ষেত্রে সমাজসেবা বিভাগের উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টিকে সেভাবে আমলেই নিচ্ছেন না।

দুই নম্বর গেট এলাকা দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ড্যান্ডি আসক্ত শিশুর সংখ্যা বড়জোর দুইশ হতে পারে। এদেরকে বুঝিয়ে সরকারি কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হলে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতো না। শুরুর দিকে ড্যান্ডি আসক্ত ৫-৭ জন শিশু-কিশোর দুই নম্বর গেট এলাকায় দেখা গেলেও এখন এদের সংখ্যা ৩০-৩৫ জন। তাদের হাতে বেøড, ছুরি এমনকি লাঠি-রডও থাকে। অবস্থা বুঝে হামলা করে টার্গেট ব্যক্তিকে।

ভুক্তভোগীরা জানান, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান থেকে পণ্য চুরির সময় ড্রাইভার গাড়ি থেকে লাঠি দিয়ে মারতে উদ্যত হলে শিশু-কিশোররাও পাল্টা হামলা করছে। দুই নম্বর গেট এলাকা ছাড়াও নগরীর জিইসি মোড়, মুরাদপুর, অক্সিজেন, দুই নম্বর গেট, লালখানবাজার, নিউমার্কেটের মোড়, পুরাতন রেল স্টেশনে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়ে সড়কের পাশে কিংবা সড়ক বিভাজকে দলে দলে শিশু-কিশোরদের পড়ে থাকতে দেখা যায়। একপর্যায়ে এসব এলাকায় চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে বেড়ায়। যা দিন দিন বাড়ছে।

জানতে চাইলে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেয়ামত উল্লাহ জানান, ড্যান্ডিতে আসক্তরা আইনের সাথে সংঘাতে শিশুর পর্যায়ে পড়ে। এরা ভাসমান। সমাজসেবা অধিদপ্তর চাইলে এদেরকে সংশোধনাগারে পাঠাতে পারে। প্রয়োজনে আমরা সবধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। কারণ ড্যান্ডিতে আসক্ত শিশুগুলো এলাকায় বিষফোঁড়ায় পরিণত হচ্ছে।

পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা জানান, ড্যান্ডিতে আসক্ত শিশু-কিশোরদের বয়স ৭-১৭ বছর। এদেরকে চাইলে গ্রেপ্তার করা যায় না। ধরলে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর বিকল্প নেই। কারণ শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আদালত খুবই সংবেদনশীল।

সন্তোষ কুমার চাকমা আরও জানান, এই ধরনের শিশুরা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাতে হলে জেলা প্রশাসন কিংবা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার উদ্যোগ নিয়েছি।

জানতে চাইলে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা পারুমা বেগম জানান, ড্যান্ডিতে আসক্ত শিশু-কিশোরদের সংশোধনাগারে কিংবা সমাজসেবার দুস্থ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো যায়। সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা পুলিশের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আমরা দুই নম্বর গেট এলাকার বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবো।

ড্যান্ডি কী?

চামড়া ও রাবার জোড়া লাগাতে আঠা বা গামের বহুল ব্যবহার হয়। হার্ডওয়্যারের দোকানে এটি সহজলভ্য। ভয়ংকর বিষয় হলো- এই গাম দিয়ে নেশা করছে শিশু-কিশোররা। তাদের কাছে এটি ‘ড্যান্ডি’ নামে পরিচিত। পলিথিনের মধ্যে ভরে শহরের পথে-ঘাটে, পার্কে, বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, বস্তিতে প্রকাশ্যে ড্যান্ডি সেবন করতে দেখা যায় পথশিশু-কিশোরদের।

ড্যান্ডি টিউবে এবং কৌটায় দু’ভাবে পাওয়া যায়। প্রতিটি টিউবের দাম ১৫০-২০০ টাকা, কৌটার দাম ৩৫০-৬০০ টাকা। এগুলো সাধারণত হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হয়। দাম বেশি হওয়ায় আসক্ত শিশুরা কৌটা কিংবা টিউব কেনে না। প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেক্ট্রনিক পণ্য রিপেয়ারের দোকান বা মুচির কাছ থেকে ২০-৩০ টাকার বিনিময়ে অল্প পরিমাণে সংগ্রহ করে।

শুধু গাম বা আঠাই নয়, জুতার কালিকেও মাদক হিসেবে সেবন করে মাদকাসক্ত এই শিশু-কিশোররা। দামে কম, সহজলভ্যতা এবং আইনত নিষিদ্ধ পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত না হওয়ায় গাম দিয়ে নেশা মহামারি আকার ধারণ করছে। পাগলা ঘোড়ার মতো শহর থেকে গ্রামের পাড়া মহল্লায় ছুটে চলছে এর বিস্তৃতি। শিশু-কিশোররা দলবেঁধে অগোচরে এ নেশায় আসক্ত হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার জানান, ড্যান্ডি মূলত আইকা গাম যা টলুইন জাতীয় পদার্থ। আর টলুইন মাদকের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু টলুইন দিয়ে তৈরি এ গাম মাদকের তালিকাভুক্ত নয়। বিষয়টি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *