ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি
টানা বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট বন্যায় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড এবং মিরসরাই উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ২০ হাজারেরও বেশি পরিবার এই বন্যার কবলে পড়েছে।
নদী ভাঙন ও পাহাড়ি ঢলে ফটিকছড়ি উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে ফটিকছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই এলাকার মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে হালদা নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে উঠে গেছে। নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হওয়ায় আশপাশের বসতিগুলিতে পানি প্রবেশ করেছে।
ফটিকছড়ি উপজেলার সর্তা ও ধুরুং নদীর পানিও বেড়েছে। এসব নদীতে পানি বিপৎসীমার উপরে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারি প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। পরিস্থিতি ভয়াবহ। পানি কমলেই শুধু ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
একুশে পত্রিকার ফটিকছড়ি প্রতিনিধি জানান, উপজেলার বাগান বাজার, দাঁতমারা, নারায়ণহাট, ভুজপুর, পাইন্দং, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, লেলাং, কাঞ্চননগর, ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট পৌরসভা, রোসাংগিরি, সমিতিরহাট, ধর্মপুর, আবদুল্লাপুর, বক্তপুর ইউনিয়নের প্রধান কয়েকটি সড়কসহ প্রত্যন্ত এলাকায় গ্রামের পর গ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে। প্রধান কয়েকটি সড়ক ও আভ্যন্তরীণ সড়ক প্লাবিত হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছ। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
কুম্ভারপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হালদার তীর ঘেঁষে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। হালদা পারের সবজিখেত পানিতে তলিয়ে একাকার হয়ে গেছে। অনেক বাসিন্দা বাড়িঘর ছেড়ে বাঁধে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছেন।
নাজিরহাট পৌরসভার কাউন্সিলর মো. শাহজাহান বলেন, ‘বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পুরো কুম্ভারপাড়া এলাকায় সৃষ্ট বন্যায় জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে। যে যার মতো করে তাদের জান মাল রক্ষায় কাজ করছেন।’
সুয়াবিল এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘তিনি পরিবার নিয়ে হালদার চরের ভেতর বসবাস করেন। গত ১০ বছর হালদায় এত পানি দেখেননি। তাঁর বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, সন্তান আর একটি গাভি নিয়ে বাঁধে আছেন।’
পাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘বন্যায় পুরো এলাকা প্লাবিত। তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। হাহাকার মানুষের। এভাবে পানি বাড়লে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘পুরো উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি সরে না যাওয়া পর্যন্ত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তিনি মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন বন্যাপরবর্তী কৃষকের সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ‘বন্যার ভয়াবহতা উর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে। দুর্গত এলাকায় ৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা ও বিশুদ্ধ পানি সরবাহে সেল গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের বরাদ্দকৃত খাদ্যশষ্য দুর্গতদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।’
অন্যদিকে খাগড়াছড়ির বানের পানিও নেমে আসছে, যার কারণে হালদা নদীর পানি বেড়েছে। তাতে করে তলিয়েছে ফটিকছড়ি উপজেলা সদরের বিভিন্ন অংশ, পাইন্দং, সুন্দরপুর, হারুয়ালছড়ি, ভূজপুর, নারায়ান হাট, দাঁতমারা, বাগান বাজার, সমিতির হাট, ধর্মপুর, নানুপুর, লেলাং, রোসাংগিরিসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন।
পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এসব ইউনিয়নের আবাদি জমি, মাছের ঘেরসহ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ন হাট পয়েন্টে হালদা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যা বুধবার ১০৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল।
এছাড়া ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার তিন মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সোহাগ তালুকদার বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গত তিন দিন ধরে হালদা নদীর বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার রাত থেকে কিছুটা উন্নতি ঘটলেও ভোর থেকে টানা বৃষ্টিতে আবার পানি বাড়ছে।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত পানির কারণে ফটিকছড়ি অংশে হালদা নদীর ২২টি পয়েন্টে নদী ভাঙন হয়েছে। পাশাপাশি অনেক স্থানে বাঁধের উপরে পানি প্রবেশ করছে। আমরা সিনথেটিক ব্যাগ বসিয়ে পৌরসভা এলাকায় পানি প্রবেশ কিছুটা কমিয়েছি, তবে ইউনিয়নগুলোতে পানি প্রবেশ করছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফটিকছড়ি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের তিন হাজার ১৭৫ পরিবার, মিরসরাই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ১২ হাজার ও সীতাকুণ্ডের ছয়টি ইউনিয়নের পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় মোট ৫০ টন চাল ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় ২৩২টি আশ্রয় কেন্দ্র ও ১২৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।