বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট
গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত ভাওয়াল রিসোর্ট। ২০১৮ সালের ৬ এপ্রিল প্রায় ১০৬ বিঘা জমির ওপর এটির যাত্রা শুরু।
পরে এতে যোগ হয় আরও ৫৪ বিঘা জমি। ৬২টি ভিলার সঙ্গে হেলিপ্যাড, রেস্তোরাঁ, জিমনেসিয়াম, সুইমিংপুল, স্পাসহ অনেক কিছু রয়েছে এর ভেতরে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই রিসোর্টের একটি বড় অংশই গড়ে তোলা হয়েছে বনের জমি জবরদখল করে। এতে নেপথ্যে থেকে সাহস জুগিয়েছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। কেননা এই রিসোর্টের এক-চতুর্থাংশ শেয়ারের মালিকানা বেনজীরের পরিবারের হাতে।
অনুসন্ধান বলছে, বনের জমি দখল করে রিসোর্ট গড়ে ওঠার সময়কালে বেনজীর আহমেদ ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার।
রীতিমতো পুলিশি পাহারা বসিয়ে বনের জমিতে সীমানাপ্রাচীর লাগিয়ে রিসোর্টের কাজ শুরু হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশকর্তা বেনজীরের বনের জমি দখল করে রিসোর্ট বানানোর ঘটনায় স্তম্ভিত বন বিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দারাও।
জানা গেছে, আম্বার গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এই ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। তবে প্রতিষ্ঠার কোনো একপর্যায়ে এতে যুক্ত হন বেনজীর আহমেদ।
ডিএমপি কমিশনার হিসেবে প্রভাবশালী হওয়ার সুবাদে রিসোর্টের ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নেন তিনি।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ভাওয়াল রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা জানান, ভাওয়াল রিসোর্টের ভেতরে ও প্রবেশমুখে বন বিভাগের ৬.৭৩ একর জমি রয়েছে। অর্থাৎ বনের বিশাল এই জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ভাওয়াল রিসোর্ট। বন বিভাগের তথ্য মতে, ভাওয়াল রিসোর্টের দখল করা জমির মধ্যে রয়েছে ৪ নম্বর বরইপাড়া মৌজার ০৩, ২৭৯ ও ২৭১ নম্বর সিএস দাগে ১১ বিঘা।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বেনজীরের ক্ষমতার দাপটে সবাই ছিলেন নির্বিকার, নিরুপায়।
তিনি তখন ডিএমপি কমিশনার থাকার কারণে বেআইনিভাবে পুলিশ পাহারায় বনের জমিতে সীমানাপ্রাচীর দেন। নিরুপায় হয়ে বনের ওই জমি উদ্ধারে উচ্ছেদ মামলা করে বন বিভাগ। মামলাটি এখনো চলমান বলে নিশ্চিত করেন রেঞ্জ কর্মকর্তা মাসুদ রানা।
সরেজমিনে গেলে ভাওয়াল রিসোর্ট সংলগ্ন নলজানী গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রিসোর্টের মালিকপক্ষ পারটেক্স গ্রুপ এবং সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ—এ কথা জানার পর বেনজীরের ভয়ে এলাকার কেউ ওদিকে যাওয়ার সাহসই করে না। যখন তারা বনের জমিতে সীমানাপ্রাচীর বসিয়ে দখল করেছে, তখন কারো সাহস হয়নি প্রতিবাদ করার।
স্থানীয়রা আরও জানায়, ভাওয়াল রিসোর্টের নির্মাণকাজ চলাকালে প্রায়ই এখানে আসতেন বেনজীর আহমেদ। কাজ চলার সময় স্থানীয় ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা দিনরাত পালা করে সেখানে পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকতেন।
পরিচয় গোপন করে কথা বললে রিসোর্টের সিনিয়র রিজার্ভেশন কর্মকর্তা জাহিদ হাসান রিসোর্টটির মালিকানায় সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার মালিকদের কয়েকজনের মধ্যে সাবেক আইজিপি বেনজীরও রয়েছেন।
এ ছাড়া ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন আহমেদও বলেছেন, ‘পারটেক্স গ্রুপের মালিকের ছেলে ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ রিসোর্টটির মালিক। তবে কার কত ভাগ মালিকানা তা জানা নেই। ’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যথারীতি এখানেও বেনজীর আহমেদ চাতুরীর মাধ্যমে নিজের নামটি ব্যবহার করেননি। স্ত্রী জীশান মীর্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামেই রিসোর্টের শেয়ার কেনা হয়। জানা গেছে, এই রিসোর্টে এক রাত থাকতে গেলে গুনতে হয় সর্বনিম্ন ১১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৭৬০ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ এলাকায় প্রতি বিঘা জমির বর্তমান মূল্য ২০ লাখ টাকা।
শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাবেক আইজিপির আরও সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। রাজধানীর বনানীতে অভিজাত হোটেল ইউনিক রিজেন্সিতে বেনজীর আহমেদের বিনিয়োগ রয়েছে। একইভাবে কক্সবাজারেও দুটি হোটেলে বিপুল অঙ্কের অর্থ লগ্নি করেছেন তিনি। পদ্মা ব্যাংক এবং কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাও কিনেছেন বেনজীর।