বাড়ছে মশার উৎপাত, চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু
এপ্রিলজুড়ে দাবদাহে পুড়েছে দেশের অধিকাংশ এলাকা। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। তীব্র গরমে মানুষের সীমাহীন কষ্ট হলেও হঠাৎ করেই যেন কমে গিয়েছিল মশার উৎপাত। তবে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে আবহাওয়া ঠান্ডা হতেই ফের বাড়তে শুরু করেছে মশা। সেই সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু আতঙ্ক।
এডিস মশার বাড়বাড়ন্ত দেখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গত বছরই বার্তা দিয়েছিলেন, মশা বাগে আনতে না পারলে ডেঙ্গু এবার হবে আরও ভীতিকর। তবে সেই সতর্কবার্তা কোনো সংস্থার কানে পৌঁছেনি। এডিস মশা যেসব সংস্থা বশে আনবে, তাদের খামখেয়ালি এবারও চোখে পড়ার মতো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা; সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা অন্য কোনো সংস্থা তা নিচ্ছে না। এ কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই এ বছরের ১২ মে পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছেন ২ হাজার ৪৬০ জন। এ পরিসংখ্যানই বলছে, এবারও মানুষের মনে কাঁপন ধরাবে ডেঙ্গু। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সরকারের গণনাতেই সারাদেশে প্রাণ যায় ১ হাজার ৭০৫ জনের। তবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি।
গত বছর ৬৪ জেলাতেই এডিস মশার অস্তিত্ব ও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গিয়েছিল। এবারও দেশজুড়ে এডিস মশার বিস্তার থাকলেও জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বসে আছে হাত গুটিয়ে। মশা নিয়ন্ত্রণে ২০২১ সালে একটি জাতীয় নির্দেশিকা প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, সেই জাতীয় নির্দেশিকার নামই শোনেননি বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি।
‘ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে জাতীয় নির্দেশিকা’য় বলা হয়, ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে পৌরসভা, উপজেলা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন প্রতি মাসে মশা পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন পেশ করবে। প্রতিটি পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তির সমন্বয়ে এ-সংক্রান্ত কমিটিও আছে। তবে প্রতিবেদন পাঠানো দূরের কথা, এ ধরনের একটি কমিটি আছে শুনে অনেকেরই ‘আকাশ থেকে পড়ার’ দশা!
নির্দেশিকায় বলা আছে, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যরা তাঁর ওয়ার্ডের মশার বিস্তার নিয়ে প্রতি মাসে ইউপি চেয়ারম্যানকে জানাবেন। কিন্তু অনেক জনপ্রতিনিধিই বিষয়টি জানেন না!
একইভাবে জেলা পর্যায়ে মশক নিয়ন্ত্রণে ২৬ সদস্যের একটি কমিটি থাকার কথা বলা আছে নির্দেশিকায়। তারা প্রতি মাসে একটি করে সভা করে মশার বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে প্রতিবেদন দেবেন। এ কমিটির সদস্যরা হলেন– জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন থেকে শুরু করে সরকারের স্থানীয় পর্যায়ের সব শীর্ষ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা, এনজিও প্রতিনিধি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। তবে তারাও জানেন না এ-সংক্রান্ত কমিটির কথা।
২০২১ সালের আগস্টে জাতীয় নির্দেশিকাটি প্রকাশের পর তা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়। নির্দেশিকাটি পাওয়ার এক মাসের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যায়ের কমিটি গঠন ও প্রতি মাসে একটি করে সভা করার কথা বলা হয়। পাশাপাশি প্রতিবছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদ মশার মাত্রা বিবেচনা করে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা তারা প্রণয়ন করে জমা দেবেন। প্রতিবছরের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য মশক নিয়ন্ত্রণের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে সে অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো কর্মপরিকল্পনাও কোনো পর্যায় থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগে আসে না।
স্থানীয় সরকার বিভাগের মশক নিয়ন্ত্রণ সমন্বয় কার্যক্রমের দায়িত্বরত কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী সচিব শামীম ব্যাপারী বলেন, তৃণমূল থেকে প্রতিবেদন না এলেও সিটি করপোরেশনগুলো চাহিদাপত্র চেয়ে চিঠি পাঠায়। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সমন্বয়কারী সাহাবুদ্দিন ব্যাপারী বলেন, সব জনপ্রতিনিধির কাছে জাতীয় নির্দেশিকাটি পাঠানো হয়েছে। কেন তারা এ বিষয়ে জানে না, তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
মশক বিশেষজ্ঞ সাইফুর রহমান বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে। এখানে মশার ওষুধের মান নিয়েও রয়েছে সমস্যা। সিটি করপোরেশন গতানুগতিক পদ্ধতিতে কাজ করে। যখন যেখানে মশা পায়, সেখানে স্প্রে করে। মশা বাড়লে শোভাযাত্রা করে। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ব্লকভিত্তিক সার্ভিলেন্স দল গঠন করতে হবে। কোথা থেকে মশা ও রোগী আসছে, সেখানে অভিযান চালাতে হবে। মশা পাওয়া গেলে সেটাকে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করতে হবে, তার শরীরে ভাইরাস আছে কিনা। এ যাচাই পদ্ধতিও এখানে নেই। মাঠ পর্যায়ের সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। কোথাও সার্ভিলেন্স টিম নেই। ক্লাস্টার (ঘাঁটি) চিহ্নিত করা হয় না বলে মশা নিয়ন্ত্রণও করা যায় না।