বিএনপি নেতাদের ‘বুক ফাটে, মুখ ফুটে না’
‘ঝরে পড়া বাসি ফুলে মালা গাঁথা হল চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির। পৃথিবীর অমোঘ বিধান ভুলে, কত সুগন্ধি ছড়াতে পারে তা দেখা যাবে ভবিষ্যতে। আশা থেকে আশংকা বেশি।’ ‘চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি এমন হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।’, ‘চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপিকে ধ্বংস করলেন!’ ‘চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কালো অধ্যায়ের শুভ সূচনা হল!’ — এমন নানা মন্তব্য ঘুরপাক খাচ্ছে খোদ কেন্দ্রীয় বিএনপির ফেসবুক পেজে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কমিটি ঘোষণা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা প্রেস বিজ্ঞপ্তির নিচে মন্তব্য ঘরে তৃণমূলের কর্মীরা অসন্তোষের কথা জানান দিচ্ছেন এভাবে।
ওই কমিটিকে ‘লন্ডন থেকে উড়ে আসা কমিটি’ আখ্যা দিয়ে রবিবার দিনভর নানা আলোচনা-সমালোচনায় সরব ছিলেন রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল। তবে দলটির নেতাদের ‘বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না’ অবস্থা! লন্ডনে ‘গিট’ লাগার ভয়ে মুখ খুলছেন না তারা কেউ। অভ্যন্তরীণ গ্রুপেও কুলুপ এঁটে দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর হেলাল উদ্দিন। সবাইকে দল ছাড়ার এক অডিও বার্তাও দিয়েছেন তিনি। মীর হেলালের এ বার্তাকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলেও অনানুষ্ঠানিক মন্তব্য করেছেন অনেকে।
অনেক নেতাকর্মী বলছেন, চট্টগ্রাম নগরে শাহাদাত-বক্করের বিকল্প তৈরি হয়নি এখনো। রাজপথের জন্য ডা. শাহাদাতের মতো নেতার প্রয়োজন। তাদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন,— ‘যাদের অস্তিত্ব মহানগরের কোনো প্রোগ্রামেই থাকে না তারা কিভাবে আগামীর মহানগর চালাবে? ‘কমিটি দেখে আ.লীগ-জামায়াতের নেতারাও হাসছেন’— এটি নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগর বিএনপির এক নেতার মন্তব্য হলেও দিনশেষে একাধিক নেতা মনে করছেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যা করেছেন দলের ভালোর জন্যই করেছেন।’
তবে এসব বিষয়ে কথা বলতে সদ্য ঘোষিত নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।
রবিবার (৭ জুলাই) বিলুপ্ত কমিটির এক নম্বর সদস্য এরশাদ উল্লাহকে আহ্বায়ক এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা নাজিমুর রহমানকে সদস্য সচিব করে কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
‘লন্ডন কানেকশনের’ কারণে এরশাদ উল্লাহকে শীর্ষ পদে বসানোর জোর সম্ভাবনার কথা উঠে আসছিল কমিটি সমাচারে। তবে নগর বিএনপির বিরাট একটি অংশ চাইছিলো ফের ডা. শাহাদাত-বক্করের কমিটি। ফলে কমিটি ঘোষণার পর ‘নাখোশ’ শাহাদাত-বক্কর পন্থীরা। শাহাদাত-বক্করের ‘মুখ’ না ফুটলেও শাহাদাতের কেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভেসে বেড়াচ্ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। কিন্তু শেষমেশ কেন্দ্রীয় নেতা মীর হেলালের ‘কমিটি’-ই হয়েছে বলে মনে করছেন বিরোধীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগর বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘নগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে ডা. শাহাদাত হোসেন না থাকায় শুধু বিএনপি নয়; আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীর অনেকে সিনিয়র নেতাও অবাক হয়েছেন। ’
চট্টগ্রাম বিএনপির ওই নেতা বলেন, ‘কমিটি যেটা দিয়েছে এটা এক নেতার কমিটি। যে কমিটি দিয়েছে সেই কমিটি দেখে শুধু বিএনপি নয়; আওয়ামী লীগ হাসছে, জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র অনেক নেতাও হাসছেন। জামায়াতের এক নেতা জিজ্ঞেসও করেছেন, এটা কোন ধরনের কমিটি দিল? কেমন কমিটি ঘোষণা করা হলো! বিএনপির হাইকমান্ড কোন বিষয়টি দেখে এমন কমিটি ঘোষণা করেছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘সকালে কমিটি ঘোষণার পর অনেকে ‘চাপে’ পড়ে নতুন কমিটিকে শুভ কামনা জানাতে ফুল নিয়ে গেলেও কর্মীদের মাঝে ছিল না হাসিমাখা মুখ। বিএনপির অধিকাংশই এ কমিটি নিয়ে খুশি নয়।’
নাম প্রকাশ করা যাবে না এমন শর্তে নগর বিএনপির আরেক নেতা বলেন, ‘তৃণমূল থেকে শুরু করে বিএনপির অনেক নেতাই এ কমিটি নিয়ে খুশি নন। যেখানে একটা কমিটি দিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অভিনন্দনের বন্যা ভেসে যায়। কিন্তু এ কমিটি নিয়ে তেমন একটা শোরগোল নেই। ফেসবুকজুড়েও ছিল না অভিনন্দনের কোনো বার্তা। এছাড়া, এ কমিটিতে যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তারা তেমন একটা এক্টিভ ছিলেন না। যেটার কারণে সবাই হতাশ।’
এদিকে কমিটি থেকে ছিটকে পড়া, বহিস্কারের ভয়ে মুখ খুলছেন না কোনো নেতা। তারা বলছেন, দলের হাইকমান্ড যা ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন।
কমিটি নিয়ে জানতে চাইলে নগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুস সাত্তার বলেন, ‘আমাদের দল চলছে। কমিটি পরিবর্তন হবে এটি একটা প্রক্রিয়া। দল সামনে সুসংগঠিত হবে। কারণ, কোনো ব্যক্তি বিএনপির জন্য অপরিহার্য না। একমাত্র খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান যাকে নেতা বানাবেন সেই নেতা। যেই কমিটি হয়েছে, আশা করছি— তারা সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করবেন। তাদের সফলতা কামনা করছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে নগর বিএনপির একজন সাবেক নেতা বলেন, ‘নতুন সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের ভোটকেন্দ্র আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়। একবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন ডা. শাহাদাত হোসেন। ওই নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছিলেন শাহাদাত। এতে বুঝা যায়, নাজিমুরও ওই নির্বাচনে নিজেই ভোট দেননি! আর এমন নেতা এবার পেলেন নগরের গুরুত্বপূর্ণ পদ।’
আরেক সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যেটা দিয়েছেন সেটার বাইরে বলার কিছু নেই। তিনি যেটা ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন।’
ডা. শাহাদাত হোসেন কমিটিতে না আসায় কিছুটা আশাহত হয়েছেন মন্তব্য করে নগর বিএনপির সাবেক সহ তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আলমগীর নুর বলেন, ‘কমিটি গঠন দলের হাইকমান্ডের বিষয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটা ভাষ্য হলো— যারা মিটিং-মিছিলের পিছনে থাকবে তারাও একদিন পদপদবিতে আসবে। নতুন কমিটির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ ভাই অনেক পুরাতন নেতা, নাজিম ভাইও ছাত্রদলের চৌকস নেতা। তবে আমরা আশা করেছিলাম— ডা. শাহাদাত হোসেনকে নিয়ে একটা কমিটি ঘোষণা করা হবে। সেটা না হওয়ায় আমরা একটু আশাহত হয়েছি। কারণ, চট্টগ্রাম বিএনপির জন্য ডা. শাহাদাতের বিকল্প বলতে কিছু নেই। উনি এক যুগে যা অবদান রেখেছেন, তা বলা বাহুল্য। তাই আমরা দলের হাইকমান্ডের কাছে আবেদন ও দাবি রেখেছিলাম— ডা. শাহাদাতকে আহ্বায়ক বা সভাপতি রেখে নতুন-পুরাতন মিলে একটা কমিটি দিবেন। যাই হোক, এটা যখন দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত; তাই উনি ভালো বলতে পারবেন দলের জন্য কোনটা ভালো হবে।’
সাবেক সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর বলেন, ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের জন্য যেটা ভালো মনে করেছেন; তিনি সেটাই করেছেন। এটা নিয়ে আমার কোনো মন খারাপ বা অভিযোগ নেই।’
মহিলা দলের সাবেক সহ-সভাপতি জেসমিনা খানম বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এটা (নতুন কমিটি) মনোনীত করেছেন। উনার ওপরে আমরা কেউই না। ডা. শাহাদাত হোসেন ও আবুল হাশেম বক্কর দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন। তবে সবকিছুর একটা ধারাবাহিকতার প্রয়োজন আছে এবং সবকিছুর পরিবর্তন দরকার। আর পরিবর্তনের জন্য নতুন কমিটি দরকার।’
মীর হেলালের হুঁশিয়ারি
এদিকে প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও বিএনপির অভ্যন্তরীণ একটি গ্রুপে সদ্য ঘোষিত এ কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীরা নানা অসন্তোষের কথা জানাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও ‘কুলুপ’ আঁটতে চান বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আসা কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মীর হেলাল। গ্রুপটিতে এক অডিও বার্তায়, অসন্তোষ জানানো নেতাকর্মীদের দল ছাড়ার কথা জানিয়ে তাদের সাথে রাজনীতি করতেও রাজি নন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির এ নেতা।
ওই অডিওবার্তায় মীর হেলাল বলেন, ‘আসলামুআলাইকুম, এই গ্রুপে যারা জয়েন আছেন, আমাদের নেতা দেশনায়ক তারেক রহমানের নির্দেশে কিছু কমিটি পাবলিশড হয়েছে, ঢাকার দুটি চট্টগ্রাম মহানগর এবং বরিশালের একটি। এ কমিটির বিরুদ্ধে যারা প্রকাশ্যে বিরূপ মন্তব্য করছেন, তারা দয়া করে লিভ নিয়ে নেন। কারণ আমাদের নেতার চেয়ে বেশি বুঝে এরকম কর্মী আমাদের সঙ্গে না থাকাটাই ভালো বলে আমি মনে করি এবং এটলিস্ট (অন্তত) আমি ওনাদের সাথে রাজনীতি করতে রাজি না। যা সিদ্ধান্ত ওনি দিয়েছেন। আমাদের কমিটি দেওয়ার আগে অনেকের অনেক চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে, কিন্তু কমিটি দেওয়ার পরে যদি কেউ এর বিরুদ্ধাচারণ করার ইচ্ছে থাকে বা এর বিপক্ষে কিছু বলার থাকে বা এর বিরুদ্ধে মত দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা থাকে এ দলের নেতাকর্মী হওয়ার পরও তাহলে তাদের নিজের পদ থেকে পদত্যাগ করা উচিত এবং আমাদের সাথে তাদের সম্পর্কটা ছিন্ন করা উচিত, ধন্যবাদ’।
উল্লেখ্য, নগর বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত হচ্ছে এমন গুঞ্জনের মধ্যেই গত ১৩ জুন ডা. শাহাদাত হোসেন ও আবুল হাশেম বক্করের নেতৃত্বাধীন কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্র।
এর আগে, ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর ডা. শাহাদাত হোসেনকে আহ্বায়ক ও আবুল হাশেম বক্করকে সদস্য সচিব করে ৩৯ সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নেতৃবৃন্দকে দ্রুততম সময়ে নগরের থানা ও ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠনের নির্দেশনা দেয় কেন্দ্র। কিন্তু কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও তা সম্ভব হয়নি। ২০২১ সালের অক্টোবরে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে এসে কেন্দ্রের নির্দেশে তা স্থগিত করা হয়।
২০১৬ সালের ৬ আগস্ট ডা. শাহাদাতকে সভাপতি ও আবুল হাশেম বক্করকে সাধারণ সম্পাদক করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়, যা পরের বছর ১০ জুলাই ২৭৫ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়।
এছাড়া ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সভাপতি এবং ডা. শাহাদাত হোসেন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নগর বিএনপির।