চট্টগ্রামমীরসরাই

মিরসরাইয়ে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা

মিরসরাইয়ে টানা চারদিনের বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় দুই লাখেরও বেশি মানুষ। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের তোড়ে এখানকার ফেনী নদীর পানির উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বুধবার (২১ আগস্ট) থেকে এখানকার ১১টি ইউনিয়ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে ততই এখানকার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সহসা বড় ধরনের উদ্ধার অভিযান ও পর্যাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা না দিলে এখানে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এখানকার বানভাসি মানুষদের উদ্ধারে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা।

মিরসরাই উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথমদিকে ফেনী নদীর তীরবর্তী করেরহাট, হিঙ্গুলী, ধুম, ওচমানপুর ইউনিয়নের বিশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হলেও শুক্রবার (২৪ আগস্ট) দিবাগত রাত থেকে এখানকার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করেছে। এগুলোর মধ্যে উপজেলার জোরারগঞ্জ, ইছাখালী, কাটাছরা ও মিঠানালা ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম ৫ থেকে ৭ ফুট পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

আশ্রয় কেন্দ্রে ২০ হাজার মানুষ:

উপজেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও ঘুর্ণিঝড় আশ্রায়ন প্রকল্প মিলে মোট ৭৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা পরিষদের প্রশাসক মাহফুজা জেরিন। তিনি জানান, শনিবার (গতকাল) সকাল ১১টা পর্যন্ত এসব আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ১১ হাজার বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। দিনান্তে এর সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার কথা।

এদিকে মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত একাধিক স্বেচ্ছাসেবীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি ৭৯টি আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরেও অন্তত ২০টি আশ্রয় কেন্দ্র বানভাসি মানুষদের আশ্রয়ের জন্য খোলা হয়েছে। এগুলো তুলনামূলক উঁচু এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে খোলা হয়েছে।

বিদ্যুৎবিহীন অসংখ্য এলাকা:

টানা চারদিন ধরে মিরসরাইয়ের ১১ ইউনিয়ের বন্যাকবলিত এলাকায় কোন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। নিরাপত্তা ও বিপদঝুঁকির কথা চিন্তা করে বিদ্যুৎ বিভাগ এসব এলাকায় বিদ্যুৎসেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যেসকল গ্রাম এখনো বন্যা কবলিত হয়নি ওইসব এলাকায় বিদ্যুৎসেবা দেয়ার চেষ্টা চলছে।

চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ মিরসরাই জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) আদনান আহমেদ জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে মিরসরাই জোনাল অফিসের আওতাধীন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় এখানকার ৭টি সঞ্চালন লাইনের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ বারইয়ারহাট জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) হেদায়েত উল্ল্যাহ বলেন, ‘গত ৩ দিন ধরে উপজেলার করেরহাট, হিঙ্গুলী, জোরারগঞ্জ, ধুম, ওচমানপুর ইউনিয়ন ও বারইয়ারহাট পৌরসভার আংশিক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। যেখানে প্রায় ২৫ হাজার গ্রাহক রয়েছেন।’

মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট:

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে ৪৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে সৃষ্টি হওয়া যানজট এখনো নিরসন হয়নি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার যানবাহন। এতে যাত্রী ও চালকদের যেন দুর্ভোগের শেষ নেই। এছাড়া সড়কে থাকা বিভিন্ন মালবাহী যানবাহনে কাঁচা ও ভোগ্যপণ্য আটকে রয়েছে গত কয়েকদিন। এতে স্থানীয় বাজারগুলোতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চরম সংকট তৈরি হয়েছে।

উপজেলার মিঠাছরা, বারইয়ারহাট ও জোরারগঞ্জ বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এখানে শুকনো খাবার, বোতলজাত পানীয়, ডিম ও কাঁচা পণ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।

মিঠাছরা বাজারের পাইকারি বিক্রেতা মৃদুল কান্তি পাল জানান, গত বুধবার এক কনটেইনার চিড়া ও পানি অর্ডার করেছিলাম। যা পথে ফেনীর ফাজিলপুর এলাকায় আটকে পড়ে। শনিবার (গতকাল) বেলা ৪টা পর্যন্তও এসে পৌঁছায়নি।

মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ইনচার্জ (পরিদর্শক) সোহেল সরকার জানান, পুলিশ রাস্তায় দায়িত্ব পালন করে লাভ হবে না। কারণ পানির কারণে গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। পানি নেমে গেলে যানজট নিরসন হয়ে যাবে।

অতিপ্লাবিত এলাকায় নেই ত্রাণ:

মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট আর আঞ্চলিক সড়কগুলোতে অতিরিক্ত উচ্চতায় পানি বয়ে যাওয়ায় অতি প্লাবিত গ্রামগুলোতে ত্রাণ ও বিশুদ্ধ পানিয় সরবরাহ করতে পারছে না স্বেচ্ছাসেবী ও ত্রাণ ও দুর্যোগ মোকাবেলায় মাঠে থাকা সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এখানকার উদ্ধার কাজও বিঘ্ন ঘটছে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। আবার মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে অতিমাত্রায় ত্রাণ ও বিশুদ্ধ পানিয় সরবরাহ করছেন অনেকেই। কিন্তু অতিপ্লাবিত এলাকাগুলোতে বানভাসি মানুষদের সহযোগিতার চেষ্টা করেও অনেকেই ব্যর্থ হচ্ছেন।

মিরসরাইয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হীতকরির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে মিরসরাই ও ফেনীর বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ত্রাণ, বিশুদ্ধ পানিয় এবং উদ্ধার কাজ করছি আমরা। ফেনী এবং মিরসরাইয়ের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে পানির তীব্রতা বাড়তি হওয়ায় কিছুতেই ত্রাণ সরবরাহ এবং উদ্ধার কাজ করা যাচ্ছে না। শনিবার (গতকাল) কিছু কিছু এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করেছি। সেনাবাহিনী এবং পুলিশও কাজ করছে।’

উপজেলার উপকূলীয় ঝুলনপুল বেণীমাধব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ খাঁন জানান, শুক্রবার সকাল থেকে স্কুলে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। শনিবার (গতকাল) বেলা ২টা পর্যন্ত এখানে এক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এলাকার সবগুলো টিওবওয়েল পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আশ্রিত মানুষের খাবারেরও সংকট আছে।

উদ্ধার স্বল্পতায় আটকে আছে বানভাসি মানুষ:

মিরসরাই উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের অন্তত ১৬৫টি গ্রাম অতিমাত্রায় প্লাবিত হয়েছে। এখানকার প্রায় দুই লাখেরও বেশি বাসিন্দা এখন বানভাসি। এদের মধ্যে সরকারি হিসেবে ১১ হাজার আশ্রয়ে কেন্দ্রে গেলেও বেসরকারি হিসাব বলছে তা ২০ হাজারের মতো। তথ্য অনুযায়ী, উদ্ধার কাজে স্বল্পতা এবং বাড়ি ঘর ছেড়ে অন্যত্র যেতে রাজি না হওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। উদ্ধার কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী যুব রেডক্রিসেন্ট টিমের লিডার রায়হান ইসলাম বলেন, ‘করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম জোয়ার, হিঙ্গুলী ইউনিয়নের আজমনগর, ধুম ইউনিয়নের গোলকেরহাট, শুক্রবারইয়াহাট, ওচমানপুর ইউনিয়নের মরগাং ও বাঁশখালী এলাকায় পানির তীব্র স্রোতের কারণে আমাদের রিস্কিউ টিম সেখানে উদ্ধার কাজে তেমন সফল হয়নি। আরেকটি বিষয় হলো যখন উদ্ধার সম্ভব ছিলো তখন অনেক পরিবার বাড়িঘর ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে চায়নি। বর্তমানে অনেকের আর্তনাদ শোনা গেলেও আমরা উদ্ধার করতে পারছি না।’

আশ্রয় কেন্দ্রে বৃদ্ধার মৃত্যু:

উপজেলার ধুমঘাট হাজি চাঁন মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে লায়লা খাতুন নামে শতবর্ষী এক বৃদ্ধা মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩ টায় তার মৃত্যু হয়। লায়লা খাতুন হিঙ্গুলী ইউনিয়নের মেহেদী নগর গ্রামের খুরশিদ আলমের স্ত্রী। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুরের ছাপা বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে আশ্রয় কেন্দ্রে আসা শতবর্ষী লায়লা খাতুন স্বাভাবিক অবস্থায় মারা গেছেন।

ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে:

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল (শনিবার) বেলা ১২টায় নদীর কালিয়াছড়ি এলাকায় পানির উচ্চতা ১১.৯৫ মিটার ছিল, যা বেলা ৩টায় কমে দাঁড়ায় ১১.৮৯ মিটারে। কালিয়াছড়ি এলাকায় পানির বিপৎসীমা নির্ণয় করা হয় ১২.৯০ মিটার। আবার নদীর শুভপুর সেতু এলাকায় শনিবার বেলা ১২টায় পানির উচ্চতা ছিলো ৫.৪৬ মিটার। যা বেলা ৩টায় ৫.৪০ মিটারে নেমে আসে। ওই এলাকায় বিপৎসীমা নির্ণয় করা হয় ৫.৯৯ মিটার। শনিবার (গতকাল) সন্ধ্যা ৬টার নাগাদ ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদ শাহরিয়ারের বরাতে এসব তথ্য জানান মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজা জেরিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *