যেভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র কাতার
মাত্র ৫০ বছরে কীভাবে এত অসাধ্য সাধন করল কাতার। কীভাবে এল বিশ্বের ধনী দেশের তালিকায়? পারস্য উপসাগরের ছোট্ট একটা দেশ কাতার। চলতি বছরও উচ্চ মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনী দেশের মধ্যে অবস্থান করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। কিন্তু এক সময় আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনায়ও প্রায় ১৩ গুণ ছোট এই কাতার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর একটি ছিল।
বাংলাদেশের মতো কাতারও স্বাধীনতা লাভ করেছিলো ১৯৭১ সালে, গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে। তবে বর্তমানে মাথাপিছু জিডিপির উপর ভিত্তি করে কাতারের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ।
গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড তাপ, এমনকি ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠে যাওয়া কাতারের বেশীরভাগ জুড়েই ছিল মরুভূমি। যার ফলে একদা এই দেশ ছিল বসবাসের অনুপযোগী স্থান। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশটির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাতার এখন গ্রহের সবচেয়ে ধনী দেশ!
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রয়েছে কাতার সরকারের আর্থিক বিনিয়োগ। এছাড়া আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিডিয়া কোম্পানি আল জাজিরার জন্মও এই দেশে। এছাড়া রয়েছে দোহা, গগনচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মল আর বিলাসবহুল গাড়ির স্রোতে ভেসে যাওয়া কাতারের রাজধানী।
এখন প্রশ্ন হল মাত্র ৫০ বছরে কীভাবে এত অসাধ্য সাধন করল কাতার। কীভাবে এল বিশ্বের ধনী দেশের তালিকায়?
কাতারের অর্থনীতি : মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ধনী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এর সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ। মরুভূমির বালির নিচে লুকিয়ে থাকা বিশাল জ্বালানি ভান্ডারই কাতারের অর্থের যোগানদাতা। তবে, কাতারের শুধু তেলই নয়, আরো একটি সম্পদ প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, আর তা হলো প্রাকৃতিক গ্যাস।
পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস হল কাতারের অর্থনীতির ভিত্তি এবং মোট সরকারী রাজস্বের ৭০ ভাগের বেশি, মোট দেশীয় পণ্যের ৬০ ভাগের বেশি এবং রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগের জন্য দায়ী। কাতারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রমাণিত প্রাকৃতিক গ্যাস রিজার্ভ রয়েছে এবং দেশটি প্রাকৃতিক গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, পেট্রোল-ভিত্তিক শিল্পের উত্থানের আগে, কাতার একটি দরিদ্র দেশ ছিল। ১৯৩৯ সালে দেশটিতে তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান শুরু হয়। এরপর ১৯৭৩ সালে, তেলের উৎপাদন এবং রাজস্ব নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়, যা বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের তালিকা থেকে কাতারকে সরিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে কাতারকে সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশে উন্নীত করে।
তবে ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কাতারের অর্থনীতি মন্দার মধ্যে ছিল। অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে ওপেক (পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলির সংস্থা) কোটা, তেলের কম দাম এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হ্রাসের কারণে সরকারের ব্যয় পরিকল্পনার পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠান প্রবাসী কর্মীদের ছাঁটাই করে। তবে ১৯৯০ এর দশকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সাথে, প্রবাসী জনসংখ্যা, বিশেষ করে মিশর এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে আবার বেড়েছে।
১৯৯৫ সালে হামাদ বিন খলিফা আল-থানি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর গ্যাস তরলীকরণের গবেষণার উপর বিনিয়োগ করা শুরু করলেন। এর ফলে গ্যাস পরিবহণের জন্য আর পাইপের প্রয়োজন হবে না, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) সহজেই জাহাজের মাধ্যমে রপ্তানি করা যাবে, যেমনটা করা হয় তেলের ক্ষেত্রে।
কাতার এই প্রযুক্তিতে এতটাই বিনিয়োগ করেছে যে, তারা LNG এর উৎপাদন খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চারগুণ কমিয়ে নিয়ে এসেছে! অর্থাৎ বিশ্বের অন্যান্য যেকোনো দেশ ১ টন LNG উৎপাদন করতে যা খরচ করে, কাতার সেই পরিমাণ খরচ করেই কম করে হলেও ৪ টন জ্বালানি উৎপাদন করে।
শিল্প : কাতারের সরকার শিল্পকে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার পরিকল্পনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে এবং এর বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদকে সর্বাধিক করে তুলেছে। কাতারের শিল্প ব্যবসা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ।
দেশটি কাতার স্টিল এবং কাতার প্রাইমারি মেটেরিয়াল কোম্পানির (QPMC) মাধ্যমে ইস্পাত এবং অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীসহ পেট্রোকেমিক্যাল এবং সার সরবরাহের একটি বিশাল শিল্প গড়ে তুলেছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে উন্নয়নের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ায় নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ যার সুবিধা নিচ্ছে কাতার।
বিনিয়োগ ব্যবস্থা : জ্বালানি সম্পদ কাজে লাগিয়ে প্রচুর আয় করেছে কাতার, কিন্তু এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে কোথায়?
কাতার এই বিশাল আয়কৃত অর্থ কাজে লাগানোর জন্য গঠন করা হয়েছে ‘কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি’। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে কাতারের আয়কৃত অর্থ দেশ-বিদেশের লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করা।
কাতারের এই ফান্ড বিশ্বের প্রতিটি কোনায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে। হোটেল, অফিস, অ্যাপার্টমেন্ট কেনার মাধ্যমে লন্ডনের বেশ বড় একটা অংশ কাতারের দখলে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিদেশি বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রের তালিকায় কাতারের অবস্থান চার নম্বরে।
আর শুধু রিয়েল এস্টেট নয়, বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতেও কাতারের বিনিয়োগের পরিমাণ আকাশচুম্বী। জার্মানির ফোক্সওয়াগেন, বারক্লেইস ব্যাংক, এমনকি রাশিয়া সরকারের তেল কোম্পানি ‘রসনেফট’-এর বিরাট অংশও কাতারের মালিকানাধীন।
বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও সড়ক ব্যবস্থা, এয়ারপোর্ট, বন্দর, গবেষণা কেন্দ্র আর বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে কাতার সরকার।
বিভিন্ন দেশের সাথে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, শিক্ষা খাত, প্রতিরক্ষা খাত, জনশক্তি আমদানিতেও প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে কাতারের।
পরিবহণ খাত : গত এক দশকে দ্রুত-বর্ধমান জনসংখ্যা এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সাথে একটি নির্ভরযোগ্য এবং বিস্তৃত পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় রয়েছে কাতার।
২০০৮ সালে গঠিত অবকাঠামো উন্নয়নের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা পাবলিক ওয়ার্কস অথরিটির মাধ্যমে বড় বড় প্রকল্প সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণের বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে দেশটি। সড়কের আধুনিকায়নই প্রধান লক্ষ্য দেশটির।
দেশটির বৃহৎ প্রকল্পের মধ্যে বহু বিলিয়ন ডলারের দোহা এক্সপ্রেসওয়ে এবং কাতার বাহরাইন কজওয়ে। যা কাতারকে বাহরাইন এবং সৌদি আরবের সাথে সংযুক্ত করে আঞ্চলিক আন্তঃসংযোগের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক গঠন করেছে।
এছাড়া পরিবহণ খাতের উন্নয়নে দোহা মেট্রো, লাইট-রেল সিস্টেম এবং আরও বিস্তৃত বাস নেটওয়ার্কের মতো গণ-ট্রানজিট ব্যবস্থার প্রতিনিয়ত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করে যাচ্ছে সরকার। সূত্র: উইকিপিডিয়া ও রোর বাংলা