চট্টগ্রাম

সংকটে ধুঁকছে রেলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ

নগরের মোহরা ওয়ার্ডের জানে আলী হাট এলাকায় ১১৬টি প্লট টেন্ডারের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে বরাদ্দ দেয় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। এক বছর আগে এসব প্লট বরাদ্দ দিলেও ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা না থাকায় প্লট মালিকদের এখনো বুঝিয়ে দিতে পারেনি ন্যায্য পাওনা। সংকটে ধুঁকছে রেলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ

ফেনী ও লাকসাম স্টেশনে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা। কিন্তু এসব জায়গা আবার দখলে নিয়েছে দখলদারেরা।

ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় সেখানে পুনরায় অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে বেহাত হচ্ছে রেলের জমি। উচ্ছেদ হওয়া জায়গা আবার দখলে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা।
বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম) ছিল না প্রায় ৯ মাস। থমকে ছিল রেলওয়ের অভিযান। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর জেলার রেলওয়ের সব জমি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার। সম্প্রতি দুই বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা যোগদান করলেও এখনো অভিযানে যাননি তারা।

বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (সদর) নেই ৪ বছর ধরে। ২০১৯ সালের পর থেকে এ পদটি শূন্য ছিল। সম্প্রতি ভূ-সম্পত্তি বিভাগের নানা তদবিরে সেখানে একজন যোগদান করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এ দুজন রেল কর্মকর্তা দীর্ঘদিন না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে রেলের জমি উদ্ধার কার্যক্রম। তাদের যোগদানে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে ভূ-সম্পত্তি বিভাগে। তবে এখনো ভূ-সম্পত্তি বিভাগে (পূর্বাঞ্চল) জনবল সংকট ১০০ জনের।

বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম) না থাকায় এতদিন এ দায়িত্ব পালন করেছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ার জিসান। তার পক্ষে এ বিশাল দায়িত্ব সামলে অন্যজনের দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব ছিল। যার কারণে তিনি একদিনও রেলের জমি উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে পারেননি।

গত চার বছর ধরে সদরের পদটি শূন্য ছিল৷ অতিরিক্ত দায়িত্বও কাউকে দেওয়া হয়নি। যার কারণে সদরে জমি উদ্ধার অভিযান নেই বললেই চলে।

এদিকে বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তাও (ঢাকা) নেই প্রায় ৬ মাস। এ বিভাগেও অভিযান পরিচালনা করতে বেগ পেতে হচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে।

নতুন বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম) দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা বাংলানিউজকে বলেন, আমি যোগদান করেছি সবেমাত্র। সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি। আশা করি ভালো কিছু হবে।

রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরে ৪টি এবং ৫টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধ দখলদার ও স্থাপনা সরাতে উচ্ছেদ অভিযানের দিনক্ষণ ঠিক করেছিল ভূসম্পত্তি বিভাগ। গত ১৮ জানুয়ারি থেকে অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ১৮ জানুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়া থানার ডুলাহাজারা স্টেশন এলাকায়, ২৪ জানুয়ারি পাহাড়তলী ওয়ার্ডের মাস্টার লেইন রেলওয়ে কলোনিতে এবং সর্বশেষ ২৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের রিভিউ পিটিশন (২৮৬/২০২৩) আদেশ অনুযায়ী পশ্চিম মাদারবাড়ির রেলওয়ে মাস্টারপ্ল্যানভুক্ত প্লট-৬১ ও ৬২-তে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার কথা। সে অভিযান এখনো পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।

বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি বিভগের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটের অভাবে শিডিউল অনুযায়ী অভিযানগুলো পরিচালনা করা যাচ্ছে না। এতদিন আমাদের নিজস্ব কোনো ম্যাজিস্ট্রেট ছিল না। সম্প্রতি বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (সদর) ও বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম) যোগদান করেছেন। আশা করি খুব শিগগিরই জমি উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হবে।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেহাত হওয়া রেলের জায়গাগুলো উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি বিভাগ বেহাত হওয়া রেলওয়ের জায়গা পুনরুদ্ধারে নামে। ২০২১ সালে রেলওয়ে বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করেছে ১০ একর। এছাড়াও বিতাড়িত করা হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার অবৈধ দখলদারকে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেড় হাজারেরও অধিক অবৈধ স্থাপনা। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে এ অভিযান প্রায় শূন্যের কোটায়।

ভূ-সম্পত্তি বিভাগে (পূর্বাঞ্চল) বিভিন্ন পদে প্রায় ১০০টি পদ শূন্য রয়েছে। এরমধ্যে সহকারী ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা নেই ২ জন, লিটিগেশন ইন্সপেক্টর ৫ জন থাকার কথা থাকলেও একজনও নেই, ঊর্ধ্বতন উপ সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ড্রয়িং) নেই ৪ জন। সার্কেল অফিসার দরকার ৭ জন। ফিল্ড কানুনগো নেই ৩ জন। উচ্চমান সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, জুনিয়র ড্রাফটম্যান নেই ১৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন পদে আরও বেশ কিছু জনবল সংকট।

রেলওয়ে বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি বিভাগের চট্টগ্রাম ও সদরে দুই পদে দুইজন কর্মকর্তা (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) নিয়োগ দিলেও তাদের জন্য নেই নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। যার কারণে দ্রুত সময়ে যে কোনও স্থানে অভিযান পরিচালনা করা ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, পূর্বাঞ্চলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগে প্রায় ৭০ শতাংশ পদ শূন্য। এছাড়া যানবাহনের বাজেট সংকটসহ অনেক বিষয়ে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রশাসন, পুলিশসহ রেলওয়ের প্রকৌশল ও রেলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেই রেলের ভূ-সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এছাড়া রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা সময়ের প্রয়োজন মিটাতে পারছে না। এটি সংশোধন ও পরিমার্জন করে জারি করা প্রয়োজন। লিজ প্রক্রিয়া সহজ ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে ভূ-সম্পত্তি রক্ষা করা কঠিন।

সুজন চৌধুরী বলেন, ভূ-সম্পত্তি দখলের নেপথ্যে সাধারণত সমাজের রাঘববোয়ালরা জড়িত থাকে। নানা অজুহাতে আদালতে মামলা করে অনেক সম্পত্তি ভোগদখল করতে থাকে। রেলওয়ের একটি আইন দপ্তর রয়েছে, এ দপ্তরকে শক্তিশালী করতে না পারলে ভূ-সম্পত্তি রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু আইন দপ্তরও তীব্র জনবল সংকটে ভুগছে। আইনজীবীদের ভাতা মানসম্মত নয়, ফলে তারা মামলা পরিচালনায় কিছুটা হলেও শৈথিল্য প্রদর্শন করেন। একজন প্রধান আইন কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করে সেখানে প্রেষণে ক্যাডার সার্ভিস থেকে নিয়োগ দিতে পারলে ভূ-সম্পত্তি বিভাগের মামলাগুলো দেখভাল করার গতি বাড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *