চট্টগ্রামরাজনীতি

কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে অতীত ঢাকতে চান নদভী : এমপি মোতালেব

সাবেক এমপি আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে নিজের অতীত ঢাকতে চান বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাংসদ ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেব।

রোববার (২৪ মার্চ) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই অভিযোগ করেন। নদভীর অপপ্রচার, মিথ্যাচার, উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সংঘাত সৃষ্টির অপচেষ্টা ও সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া অশালীন বক্তব্যের প্রতিবাদ ও তার পরিবারের অর্জিত অবৈধ সম্পদের উৎস ও বিদেশে অবৈধ অর্থ পাচারের অনুসন্ধানে দুদকের তদন্ত ও বিচারের দাবিতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সাংসদ এম এ মোতালেব বলেন, ‘গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখাত সাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা নদভী গত ২১ মার্চ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে কাল্পনিক, অবান্তর ও প্রতিহিংসামূলক মিথ্যাচার করে বক্তব্য রেখেছেন। তার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই বক্তব্য চট্টগ্রাম-১৫ আসনের জনমনে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আজকের এই সংবাদ সম্মেলন।’

‘আমি যেসব সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও চোর-বাটপারদের ইতোমধ্যে দমন করেছি, তাদের পক্ষ নিয়েই নদভী উক্ত সংবাদ সম্মেলন করেছেন বলে আমার স্থির বিশ্বাস। কারণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি অসংলগ্ন প্রলাপের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছেন। আবু রেজা নদভী সাহেবের বিরুদ্ধে তার পাড়া-প্রতিবেশীরা কয়েকদিন আগে পাওনা টাকা, জমি, ইটভাটা ফেরত চেয়ে এবং একই সাথে তার দুর্নীতির বিচার চেয়ে বিশাল মানববন্ধন করেছে স্থানীয় দেওদিঘী বাজারে।’

এমপি মোতালেব বলেন, ‘সেই মানববন্ধনে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মিথ্যা মামলায় জর্জরিত, নির্যাতিতদের আহাজারিতে সেদিন দেওদিঘীর বাতাস ছিল ভারী। নদভী সাহেবের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতির সবচেয়ে বড় সাক্ষী তো ওই মানববন্ধনকারীরাই, যারা তার হাতে দীর্ঘ দশ বছর নির্যাতিত, তার ভাইপোর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিল। নদভী সাহেবের নানা কীর্তির কথা দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ও গণমাধ্যমে দফায় দফায় প্রচার হয়েছে। কে না জানে উনার অপকর্মের কথা! এখন হঠাৎ সাংবাদিক সম্মেলনে শালীনতার সীমা অতিক্রম করে তিনি শাক দিয়ে মাছ ডাকতে চেয়েছেন। তাই তো আমার নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়কারী খ্যাতিমান চিকিৎসক ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য প্রফেসর ডা. আ. ম. ম মিনহাজুর রহমানকে লক্ষ্য করে মিথ্যার তীর ছুঁড়তে দেখলাম।’

‘যদিও এই তীর ইতিমধ্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস, কারণ ডা. মিনহাজকে এলাকার মানুষ ভালোবাসেন, তার কথায় আস্থা রাখেন। তার দেওয়া ‘বউত দিন হাইয়্যু, আর নঅ হাইয়্যু, তোয়ার বউয়ে হাইয়্যে, শালায় হাইয়্যে, ভাইপোতে হাইয়্যে, ভাইজি হাইয়্যে, আর নঅ হাইয়্যু’ নির্বাচনের সময়ে তার বক্তৃতা ও স্লোগান দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে থাকা প্রবাসীদের মধ্যেও গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। সে গণজাগরণে নদভী ভেসে গেছেন, এজন্যই ডা. মিনহাজের বিরুদ্ধে তার এ মনোজ্বালা, এতো ক্ষোভ। উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো যায় না। সামাজিক গণমাধ্যমে নদভী সাহেবের সংবাদ সম্মেলনকে ঘিরে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া মন্তব্য পড়লে আপনারা সহজেই অনুমান করতে পারবেন মানুষের কাছে তিনি কতোটা অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছেন।’ বলেন এমপি মোতালেব।

তিনি আরও বলেন, ‘জীবনে একদিনও আওয়ামী লীগ না করে দুইবার আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছিলেন নদভী সাহেব। তারপর স্ত্রী, ভাইপো, শ্যালক, ভাগিনা, এপিএসরা সিন্ডিকেট করে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছিলেন সাতকানিয়া লোহাগাড়াকে। এখন চোরের মায়ের বড় গলা হয়েছে। তিনি নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা ও নিষ্পাপ প্রমাণ করতে চান। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনে কাল্পনিক, অবাস্তব ও প্রতিহিংসামূলক সারমর্মহীন বক্তব্য রেখে নিজেই হাসির পাত্র হয়েছেন। আমার প্রশ্ন, সাতকানিয়া লোহাগাড়ার আইনশৃংখলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল বলে তিনি কি সরকারকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ বুঝাতে চান কিনা? তার তীর আমার দিকে না কি সরকারের দিকে? তা পরিষ্কার করতে হবে।’

‘সংবাদ সম্মেলনে নদভী ৬ খুনের মিথ্যা গল্প ফেঁদেছেন। এই গল্প অগ্রহণযোগ্য, নিন্দনীয় ও তথ্য-প্রমাণহীন। সাতকানিয়া লোহাগাড়ার দুই থানার ওসি এই বক্তব্য প্রত্যাখান করে সংবাদপত্রে বলেছেন, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় কোনো রাজনৈতিক সহিংসতা নেই, ৬ মার্ডারের বিষয়টা কাল্পনিক। সাবেক এমপির নিজ এলাকা মাদার্শায় মাদক নিয়ে বিরোধে একজন নিহত হয়েছেন, অভিযুক্ত সকল আসামি গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন, আর কোনো মার্ডার গত আড়াই মাসে হয়নি।’
সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের এমপি এম এ মোতালেব বলেন, ‘মূলত নদভী সাহেব কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে নিজের অতীত ধামাচাপা দিতে চান। কিন্তু ইতোমধ্যে থলের বিড়াল তো বেরিয়ে পড়েছে। নদভী সাহেব এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা গ্রামে কয়েকজনের মালিকাধীন একটি ব্রিকফিল্ড অন্যজনের নামে নিজের প্যাডে লিখে দিয়ে রাতারাতি কয়েক লাখ ইট লুট করেছিলেন। টিআর ও কাবিখা প্রকল্পগুলো এমনভাবে বন্টন করেছিলেন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন, যাতে তিনি এবং তার পরিবার আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে, দশ বছর আগে তার বাড়ি কুঁড়ে ঘর ছিল, এখন প্রাসাদ হয়েছে।’

নদভীর ক্ষমতার দাপটে অতীতে ইউএন ও পিআইওরা অসহায় ছিলেন উল্লেখ করে এমপি মোতালেব বলেন, ‘সরকারি প্রকল্পে নয় ছয় করে, ঠিকাদারদের কাছ থেকে পার্সেন্টেজ নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সিন্ডিকেট করে অবৈধভাবে অনিরাপদ গ্যাস পাম্প স্থাপন, অবৈধভাবে পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে সেচ কাজ করা, মাটি কাটা, পিকআপ গাড়ির টোকেন বাণিজ্য, ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, বদলি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য এসব কিছুর অভিযোগই তার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ করছে, তিনি তার কোনো সদুত্তর এখনো দিতে পারেননি। এসব অনাচারের প্রতিবাদ করেই ডা. মিনহাজ তার থেকে দূরে সরে এসেছিলেন। ডা. মিনহাজ একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক, সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ, তিনি চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের অধ্যাপক।’

‘স্বজনপ্রীতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন, যিনি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন, মাদকের হাট নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, যিনি কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তিনিই যখন অন্যের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন তখন আমরা হাসবো, না কাঁদবো, তা বুঝতে পারি না।’

এমপি মোতালেব বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিয়েছি, তাঁর একজন কর্মী হিসেবে সাতকানিয়া-লোহাগাড়াকে আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলবো। তাই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে সম্পর্ক মজবুত করে সংগঠনকে শক্তশালী করতে সর্বদা চেষ্টা করে যাচ্ছি। জামায়াত-বিএনপি এখন এ এলাকায় আর হরতাল অবরোধ করার মতো সক্ষমতা রাখে না। আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতার কারণে তারা কোণঠাসা। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিনি জামায়াতের জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন। জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা তো তিনিই করেছেন, আর এখন মায়াকান্না করছেন। আমার পরিবারের সবাই, আমরা মাননীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাশীল। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যেকটি নির্দেশনা মেনে চলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সুতরাং পরিবার তুলে বিদ্রুপ করে মূলত তিনি আমার মানহানির চেষ্টা করেছেন। আমি তার এমন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই।’

নদভীর পিএইচডি ভুয়া কিনা তা ইউজিসি কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নদভী সাহেব এ বিষয়ে ইউসিজির একটি প্রত্যয়ন নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ করলে বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন। তিনি তা না করে জনগণের মনে জেগে থাকা প্রশ্নকে থামিয়ে দিতে অহেতুক রাগ দেখাচ্ছেন। হাসপাতাল করার নামে চাঁদাবাজি করেছেন বলে এমপি নির্বাচিত হবার পরে অনেকেই আমাদের অভিযোগ দিয়েছেন। আমি তো তাকে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করি নাই। এখন পাওনাদাররা পাওনা টাকা আদায়ে মানববন্ধন করছে। এটার দায় তিনি আমার ঘাড়ে তুলে দিতে পারেন না। নদভী সাহেবের প্রতিষ্ঠিত এনজিও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় উক্ত প্রতিষ্ঠানের কিছু প্রাক্তন কর্মচারী এবং কিছু মসজিদ কমিটির সভাপতি উত্থাপন করেছেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেছেন তাদের কাছ থেকে অযৌক্তিকভাবে পারসেন্টেজ কেটে নেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগ তো আমার নয়। আমি যতটুকু জানি আন্তর্জাতিক জঙ্গি কানেকশনের অভিযোগে উনার উক্ত এনজিওটি কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। এ বিষয়ে এ পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দিয়ে তিনি বিষয়টি পরিস্কার করেননি। সুতরাং মানুষ তো যা জানে সে মতোই মন্তব্য করবে।’

এমপি এম এ মোতালেব বলেন, ‘বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নদভী সাহেব প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘এক ভোট পেলেও এমপি হবো’ এই বক্তব্যের ভিত্তি কী ছিলো তা কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করেন নাই। তার স্ত্রীর ছায়ায় শ্যালক চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ গভীর নলকূপ দেওয়ার নামে টাকা নিয়েছিলেন, বালুমহাল বাণিজ্য করতে গিয়ে কৃষকদের গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলেন। সে অপরাধে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, জনরোষের ভয়ে এলাকায় যান না। অথচ বলা হচ্ছে তাকে আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের কৃতকর্মের ফলভোগ তারা করবে, অপরাধীর বিচার দেশের আইনানুযায়ী হবে, নদভী সাহেব সংবাদ সম্মেলনে দেশের প্রচলিত আইন প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বক্তব্য রেখেছেন মাত্র।’

‘সংবাদ সম্মেলনে নদভী সাহেব আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে হত্যাকাণ্ডের আশংকা করছেন। গত সংসদ নির্বাচনেও তিনি ২০-৩০টা মার্ডারের কথা বলেছিলেন প্রকাশ্যে। তিনি উপজেলা নির্বাচনে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করছেন কিনা জানি না, তবে এ বিষয়ে প্রশাসনসহ নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার অনুরোধ করছি। পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও সচেতন দৃষ্টি কামনা করছি।’ যোগ করেন চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাংসদ এম এ মোতালেব।

সংবাদ সম্মেলনে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *