কুরআন-হাদিসের আলোকে সেহরি ও ইফতারের সময়
তোমরা পানাহার করো, যে পর্যন্ত না তোমাদের কাছে ভোরের কালো রেখা থেকে সাদা রেখা প্রকাশ পায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম বা রোজা পালন করো। (সুরা বাকারা: ১৮৭)
পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতে সেহরি ও ইফতারের সময় আল্লাহ পাক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যে বিষয়ে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায়, সে বিষয়ের ফয়সালার জন্য হাদিস, ইজমা কিয়াসের আর প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া হাদিস দিয়ে পবিত্র কুরআনের কোনো স্পষ্ট নির্দেশকে রদ করা যায় না। এ ব্যাপারে ওলামায়ে উম্মাহ একমত।
বিশেষ করে ইফতারের সময় যদি আমরা পবিত্র কুরআনের আয়াত ও মহানবীর (সা.) পবিত্র হাদিসের আলোকে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা চালাই তাহলে প্রতীয়মান হয়, ইফতারের সময় সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত নিয়ম ও সময় পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত সময় ও নিয়মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
সেহরি ও ইফতারের সময়সূচি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট আয়াত বা হুকুম বিদ্যমান। যেমন ওপরের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তোমরা পানাহার করো, যে পর্যন্ত না তোমাদের কাছে ভোরের কালো রেখা থেকে সাদা রেখা প্রকাশ পায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পালন করো। ’
ইফতারির সময় সম্পর্কে যাতে উম্মাহর মধ্যে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি না হয় তার সব প্রমাণ, নির্দেশ, দলিল ও ব্যাখ্যা পবিত্র কুরআনে বিদ্যমান। আল্লাহ দিবা-রাত্র এবং মধ্যবর্তী বিভিন্ন সময় উল্লেখ করতে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘লাইল’ অর্থ রাত। এটি পবিত্র কুরআনে ১৬২টি স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত ‘লাইল’ শব্দ দ্বারা কখনো, কোনোভাবেই সন্ধ্যাকে বা সূর্যাস্তের সময়কে বুঝায় না।
অনুরূপভাবে সকালকে ‘বুকরা’, অপরাহ্ণকে ‘নাহার’ বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বিকালের সময় সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা ‘সুরা আল আসর’ বিদ্যমান। সন্ধ্যা সম্পর্কে ‘আছিল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (১৩:১৫)। প্রভাতকালকে বোঝাতে সুরা মুদাচ্ছিরের ৩৪ নম্বর আয়াতে ‘সুব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সূর্যাস্তের সময়কে পবিত্র কুরআনের সুরা তাহা : ১৩০, সুরা কাহাফ : ৮৬ এবং সুরা ক্বাফ-এর ৩৯ নম্বর আয়াতে ‘গুরুবে শামস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে রক্তিম আভার সৃষ্টি হয় এবং এটি ১৮ থেকে ২৬ মিনিট পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। এ সময়টুকুকে সুরা ইনশিক্বাকের ১৬ নম্বর আয়াতে ‘শাফাক্ব’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। আর শাফাক্বের পূর্ণ সমাপ্তির পরই যে ‘লাইল’ বা রাত শুরু হয় তাও সুরা ইনশিক্বাকের ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
উল্লিখিত সমস্ত আয়াত দ্বারা সু¯পষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে, ‘লাইল’ বা রাত হলো এমন একটি সময় যা পরিপূর্ণভাবে বা সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন, যেখানে দিনের আলোর উপস্থিতির কোনো প্রশ্নই আসতে পারে না। ‘লাইল’ অর্থ রাত, শাফাক্ব, গুরুবে শামস, আসর বা আছিল নয়। আল্লাহর কুরআন সত্য এবং কুরআনে নির্ধারিত সময় সত্য হলে আমরা যে সন্ধ্যা বা গুরুবে শামসের সময় ইফতার করি তা পবিত্র কুরআনের অমোঘ নির্দেশের পরিপন্থী। পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা আছে, ‘আতিম্মুছ ছিয়ামা ইলাল লাইল’ অর্থ রাত্রে তোমরা সিয়াম পূর্ণ করো। হাদিস শরিফ থেকেও আমরা প্রমাণ পাই যে আল্লাহর রাসুল (সা.), সাহাবায়ে কেরামেরা কখনো গুরুবে শামস বা সন্ধ্যার সময় ইফতার করেননি। সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন তথা রাত শুরু হবার পরই তাঁরা ইফতার করতেন।
ইমাম মালেকের মুয়াত্তার প্রথম খ-ের ২৩৯ পৃষ্ঠায়, ৬৯৪ নম্বর হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘হুমহিদ ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, উমর বিন খাত্তাব (রা.) ও উসমান বিন আফফান (রা.) উভয়ে মাগরিবের নামাজ পড়তেন এমন সময় রাত্রির অন্ধকার ছেয়ে যেত আর তা ইফতারের আগে। এরপর তাঁরা উভয়ে ইফতার করতেন। এ শিক্ষা তাঁরা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকে পেয়েছেন। ’
বুখারি ও মুসলিম হাদিসে হজরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘সূর্যাস্তের পর যখন পূর্বদিক থেকে অন্ধকার হয়ে আসে এবং দিনের আলো পশ্চিম দিক থেকে সম্পূর্ণ চলে যায় তখন রোজাদারদের জন্য ইফতারের সময়’ (আরো দেখুন তফসিরে ইবনে কাসীর, দ্বিতীয় খ-, পৃ. ৯৮ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)। সূর্যাস্তের সাথে সাথে তথা পবিত্র কুরআনের ভাষায় ‘গুরুবে শামস’ ওয়াক্তে যারা ইফতার করে সারা দিনের রোজাকে নষ্ট করে দেন, তারা যুক্তি বা দলিল হিসেবে বুখারি ও মুসলিমের একটি হাদিস উল্লেখ করে থাকেন। এটি হলো হজরত ইবনে সা’দ সায়েদি থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যতদিন মানুষ জলদি ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে’। (বুখারি ও মুসলিম)
সত্ত্বর ইফতার করার মানে এ নয় যে, ইফতারের সময় হওয়ার আগেই ইফতার করে ফেলতে হবে। রাসুলুল্লাহর (সা.) এ হাদিস দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে যে, ইফতারের সময় হলে বিলম্ব না করে যেন ইফতার করে ফেলা হয়। এখানে সত্ত্বর বলতে কিছুতেই মাগরিবের আজানের সময়কে বুঝায় না। পবিত্র কুরআনে ‘আতিম্মুছ ছিয়ামা ইলাল লাইল’ অর্থাৎ রাত্রের দিকে রোজা পূর্ণ করার স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো সূর্যাস্তের সময় ইফতার করার নির্দেশ দিতে পারেন না। সূর্যাস্তের পরও প্রায় ২৫ মিনিট পর্যন্ত রক্তিম আভা থাকে যাকে ‘শাফাক্ব’ বলা হয়েছে। ওই সময়ও ইফতারের সময় নয়। পশ্চিম আকাশ সম্পূর্ণরূপে অন্ধকারাচ্ছন্ন হলে পরেই ‘লাইল’ শুরু হয় এবং ওই সময়টিই পবিত্র কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক সত্যিকারের ইফতারের সময়।
আল্লাহ পাক আমাদের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন এবং পবিত্র কুরআনের আদেশ-নিষেধ মেনে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।