চট্টগ্রাম

টেন্ডার জালিয়াতি, খাদ্য কর্মকর্তাকে সতর্ক

পিপিএ, পিপিআর ও আদর্শ দরপত্রের কোন তোয়াক্কা না করে মনগড়া শর্তের মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বান ও অনুমোদন করায় এখন ফেঁসে গেলেন জেলা খাদ্য কর্মকর্তা। রায়ে বলা হয়েছে, বিধি-বহির্ভূতভাবে আদর্শ দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করে টেন্ডার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। টেন্ডার জালিয়াতি, খাদ্য কর্মকর্তাকে সতর্ক

এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য তাকে ‘সতর্ক’ করা হয়েছে। একইসঙ্গে আপিলকারী ঠিকাদার তার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন। আপিলকারী তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবির প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা যায়।

গত ২৫ মার্চ এ রায় দিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির রিভিউ প্যানেল। প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন সরকারের সাবেক সচিব মো. ফারুক হোসেন এবং সদস্য ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ নুরুজ্জামান, ড. নাদিয়া বিনতে আমিন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আদর্শ দরপত্রের অপরিবর্তনশীল শর্ত পরিবর্তন করে নতুন ১৩ শর্তবিশিষ্ট নির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে। নিজের মতো করে শর্তযুক্ত করায় টিডিএস ও আদর্শ দরপত্রের ১১ দশমিক ১ ধারার (এ ও বি উপধারা) মূলনীতি বদলে গেছে। সংযোজিত এই দুটি নির্ণায়ক আইটিটির নির্দেশনাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। যা পিপিএ-পিপিআর ও আদর্শ দরপত্র দলিলের গুরুতর ব্যত্যয়। ১০০ নম্বরের ভিত্তির যে সংযোজন করা হয়েছে তা বিধিসম্মত হয়নি বলে মতামত দেয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীন গতকাল শনিবার রাতে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘আপনারা শান্তি পেয়েছেন তো? এখন ঈদের সেলামির ব্যবস্থা করতে হবে।’ এরপর মোবাইলের লাইন কেটে দেন তিনি।

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ২০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার ১৬ এলএসডি খাদ্যগুদামের শ্রম ও হস্তার্পণ (হ্যান্ডলিং) টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ১৪ জানুয়ারি ছিল টেন্ডার দাখিলের শেষদিন। ১১৬ জন ঠিকাদার এতে অংশ নেন। এর মধ্যে ৬৭ জনের দরপত্র বাতিল করে ৪৯ দরপত্র যোগ্য ঘোষণা করা হয়। এবার ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে নতুন শর্ত সংযোজন করে টেন্ডার প্রক্রিয়া করা হয়।

টেন্ডারের শুরু থেকেই এই পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ ঠিকাদাররা। অভিযোগ ছিল, খাদ্য কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে একটি সিন্ডিকেটকে বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে টেন্ডার পাইয়ে দিতে মনগড়া শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফাঁকফোকরে সাধারণ ঠিকাদাররা যাতে অংশগ্রহণ করতে না পারে।

ঠিকাদারদের অসন্তোষ :
হ্যান্ডলিং সংক্রান্ত দরপত্রের পূর্বের নিয়ম পরিবর্তন করে প্রথমবারের মতো এসটিডি পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করে খাদ্য বিভাগ। একটি বিশেষ সিন্ডিকেটকে ঠিকাদারির কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য খাদ্য বিভাগ এ ধরনের ‘বিরল টেন্ডার’ আহ্বান করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ৮২ ঠিকাদার। ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে ২০ নম্বরের ৫টি মানদ-ে দরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। দরপত্রের ৩ ও ৪ নম্বর বিশেষ শর্ত পূরণ করা পুরনো সিন্ডিকেট ছাড়া অন্য ঠিকাদারদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ৫-৬ জনের একটি সিন্ডিকেট পুরো খাদ্য বিভাগকে লুটেপুটে খাচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী, খাদ্য সচিব এবং খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগ করেছেন তারা।

খাদ্য অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও কোন সুরাহা না হওয়ায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে আপিল আবেদন করেন মেসার্স ইমরান এন্ড ব্রাদার্সের মালিক এসএম আবু মনসুর। বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) আপিল আমলে নেয়। দু’পক্ষের শুনানি শেষে রায় দেন তিন সদস্যের রিভিউ প্যানেল।

এ বিষয়ে অভিযোগকারী এসএম আবু মনসুর পূর্বকোণকে বলেন, ‘এটি একটি যুগান্তকারী রায়। খাদ্য কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক হিসেবে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে এবং আমাকে ক্ষতিপূরণ দাবি করার রায় দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেটকে কাজ পাইয়ে দিতে খাদ্য নিয়ন্ত্রক আইনের তোয়াক্কা না করে মনগড়া শর্ত সংযোজন করে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা হয়।’

সম্প্রতি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সংযোজিত ১০০ নম্বর ও নতুন ১৩টি শর্ত পিপিএ ও পিপিআর এবং আদর্শ পরপত্র দলিলের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মতামত দেয়া হয়। এর ফলে এই শর্তে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলার ১৬ খাদ্যগুদাম, নগরের দেওয়ানহাট ও হালিশহর খাদ্যগুদাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, আশুগঞ্জ ও চট্টগ্রাম সাইলোর টেন্ডার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ ঠিকাদাররা।

আপিল শুনানিতে অভিযোগকারী এসএম আবু মনসুর বলেন, ‘দরপত্রে খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও টেন্ডার কমিটির সভাপতির দস্তখত-পৃষ্ঠা নম্বর নেই। স্ট্যান্ডার্ড ডকুমেন্ট আইটিটির ৪৪ দশমিক ২ এর এ উপধারায় ১০০ নম্বরের মানদ-ের শর্ত নেই। খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে চুক্তিকারী রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজের মালিক আবদুর রাজ্জাক উপস্থিত না হয়েই চুক্তিপত্র সম্পাদন করেছেন। ওই সময়ে তিনি কানাডা ছিলেন। একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে দুর্নীতি ও চক্রান্তমূলক কাজের মাধ্যমে দরপত্র পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছেন।’

শুনানিতে খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীন বলেছিলেন, টিডিএস ও অতিরিক্ত শর্ত সদরদপ্তর থেকে পেয়েছেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করেছেন। তবে আদর্শ দরপত্রে দলিল ও নতুন ১৩টি শর্ত যুক্ত করার বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন এবং কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি।

রিভিউ প্যানেলের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এসএম আবু মনসুর তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবির প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তার ঘনিষ্ঠসূত্র। তবে আবুল মনসুর বলেন, ‘আইনজীবী ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে পরামর্শ করেই খাদ্য কর্মকর্তার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবির আবেদন করবো।’

১৬ গুদামের টেন্ডার যারা পেয়েছেন :
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, হাটহাজারী, কাটিরহাট, বোয়ালখালী ও সাতকানিয়ার খাদ্যগুদামের ঠিকাদারি পেয়েছেন মেসার্স জয় কনস্ট্রাকশনের মালিক আবদুর রাজ্জাক। তিনি দেওয়ানহাট সিএসডি গুদামেরও ঠিকাদার। সীতাকুণ্ড গুদামের কাজ পেয়েছেন মেসার্স রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজের মালিক আবদুর রাজ্জাক। হালিশহর খাদ্যগুদামের ঠিকাদারও তিনি। এছাড়াও সন্দ্বীপ ও রাঙ্গুনিয়া গুদামের কাজ পেয়েছেন মেসার্স হাসান এন্ড কোং প্রতিষ্ঠানের মালিক মাসুদ হাসান। হাবিলদারবাসা ও নাজিরহাট গুদামে কাজ পেয়েছেন আসাদ ট্রেডিংয়ের মালিক আসাদুজ্জামান মজুমদার। রাউজানে মেসার্স তারিফ এন্টারপ্রাইজের মোরশেদা বেগম। তিনি তানজিলা এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম রব্বানীর স্ত্রী বলে জানা যায়। তানজিলা এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে লোহাগাড়া ও চাঁনপুরঘাট গুদামের ঠিকাদারি। পটিয়ায় লোটাস এন্টারপ্রাইজ, দোহাজারীতে এস কে ট্রেডিং, আনোয়ারা গুদামে জনি এন্টারপ্রাইজ, মিরসরাইয়ের কাজ পেয়েছেন জাহিদ এন্টারপ্রাইজের জাহিদ হোসেন।

অভিযোগ রয়েছে, কয়েকজন ঠিকাদার খাদ্য বিভাগের শর্তমতে ডকুমেন্ট দাখিল না করেই কাজ পেয়েছেন। একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের সদস্যরা মিলেমিশে কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *