তিন বছরে চট্টগ্রামে ২৯৫ জনের আত্মহত্যা, ১৪ কারণে আত্মহত্যা বেড়েছে
দেশে ১৪ কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। গত তিন বছরে ঢাকার পরে চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যায় বেশি শিক্ষার্থী মারা যায়। এ বিভাগে গত তিন বছরে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ১৭৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির ১৪ কারণ হচ্ছে- প্রেমে ব্যর্থতা, একাকীত্ব, রাগ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, অতিচঞ্চলতা, মানসিক চাপ, আত্মবিশ্বাসের অভাব, ভাল ফলাফলের চাপ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানির শিকার, মোবাইল ফোনে আসক্তি, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না হাওয়া, বিনোদনের অভাব, পারিবারিক মেলবন্ধন তৈরি না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।
বেসরকারি সেবামূলক সংস্থা আঁচল’র জরিপ অনুসারে, আত্মহত্যার দিক থেকে চট্টগ্রামের অবস্থান দ্বিতীয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে গত তিন বছরে চট্টগ্রামে ২৯৫ জন আত্মহত্যা করে। এরমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে ১৭৯ জন। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ৯৮ টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, ২০২২ সালে ১০৮ জন ও ২০২৩ সালে ৮৯ জন আত্মহত্যা করে। এদের মধ্যে ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তবে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে নারী শিক্ষার্থীরা।
শুধু নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ বিবেচনায় দেখা যায়, ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ অভিমান ও প্রেমঘটিত কারণে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৭ দশমিক ১ শতাংশ, যৌন হয়রানির কারণে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং পড়াশুনার চাপজনিত কারণে ৪ দশমিক ২ শতাংশ আত্মহত্যা করে। এছাড়া পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় একই সংখ্যক শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেয়। পারিবারিক নির্যাতনে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, অপমানে ০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্খিত ফলাফল না পাওয়ার কারণে ২ দশমিক ৯ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তর বিবেচনায় আঁচল প্রকাশ করে, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ ছিলো স্কুলগামী। এছাড়া আত্মহত্যাকারীদের মাঝে কলেজগামী শিক্ষার্থী ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ১৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং আত্মহননকারীদের মাঝে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোর বয়সে হরমোনজনিত কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন। যার ফলশ্রুতিতে তারা আত্মহত্যার মতো অতি আবেগীয় সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকে। একারণে আত্মহত্যার প্রবণতা তরুণদের মধ্যে আরো বেড়েছে।
শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিব্যক্তিত্ব হাসিনা জাকারিয়া বেলা বলেন, প্রতিটি মানুষের জীবনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পরিবার। এখানে যদি শিশুরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে তবে পরবর্তী জীবনে তাকে সবরকম সমস্যার মোকাবেলা করতে শেখায়। সামাজিক অস্থিরতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এখন মানুষ খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক। একে অন্যের সাথে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলে না। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার তৈরির কারণে মানুষ একাকীত্বে ভুগছে।
গত কয়েক বছরে দেখা যায়, মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা করছে। এসব কিছুই হচ্ছে একাকীত্বের কারণে। আবার নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বরাবরই বেশি ছিল প্রেমঘটিত কারণে। গত কয়েকবছর ধরে যোগ হয়েছে পরকিয়া। এছাড়া পারিবারিক কলহ, যৌতুক, নারী নির্যাতন ও সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ ব্যবহার। এ মাধ্যমে নারীদের নানারকমভাবে হয়রানিই অনাকাঙ্খিত আত্মহত্যার বড় কারণ।
আবার ইদানিং স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা খুব বেড়ে গেছে। যা খুবই আতঙ্কের। এ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মূলত আত্মহত্যা করছে পারিবারির অস্থিরতার কারণে। অভিভাবকরা পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অন্য শিক্ষার্থীর সাথে তুলনা করে। সন্তানের উপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসব কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আবার আত্মহত্যার পেছনে কোনো না কোনো মানসিক রোগও রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণার দিকে তাকালেও দেখা যায় বিষন্নতা, মদ্যপান বা মাদকের অপব্যবহার, সিজোফ্রেনিয়া ও ব্যক্তিত্ব রোগের কারণেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে।