আন্তর্জাতিক

নিহত রাইসি: তদন্তে নামছে ইরান, ইসরায়েলিদের উচ্ছ্বাস

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ানকে বহন করা হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্তের পেছনে এখন পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে অতীত ইতিহাস ও সমসাময়িক ঘটনার কারণে এর পেছনে ইরানের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা ইসরায়েলের নামও উঠে আসছে। এমন অভিযোগ ইরানের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত না উঠলেও ইসরায়েল সম্পৃক্ত আছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। অবশ্য এই বিষয়ে ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। ইরানি সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন সাংঘর্ষিক তথ্য, সরকারি কর্মকর্তাদের মন্তব্য ও পরে তা ভুল প্রমাণিত হওয়া দুর্ঘটনাটির কারণ নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।

ইরানি সংবাদমাধ্যমে বিভ্রান্তি

রাইসির হেলিকপ্টারটির রাডার থেকে বিচ্ছিন্ন ও ক্র্যাশ ল্যান্ডিংয়ের খবর ইরানি বার্তা সংস্থাগুলো প্রকাশ করে, রবিবার জিএমটি সময় ১৩টায়। এরপর একাধিক সাংঘর্ষিক খবর সামনে আসে। পরে সেগুলো মিথ্যা বা ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। শুরুতে বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ও সব আরোহী জীবিত আছেন এবং গাড়ির বহর নিয়ে তাবরিজ শহরের পথে রয়েছেন। পরে এটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।

এরপর দাবি করা হয় হেলিকপ্টারের অন্তত একজন আরোহী ও ক্রু সদস্যের সঙ্গে উদ্ধারকর্মীদের যোগাযোগ হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থলের দিকে এগোচ্ছে উদ্ধারকর্মীরা। রাতভর উদ্ধার অভিযান অব্যাহত ছিল। কিন্তু যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল তা ছিল অনেক বেশি সাংঘর্ষিক। সন্ধ্যার শেষ দিকে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, রাইসির সঙ্গে থাকা ইমাম মোহাম্মদ আলি আল-হাশেম দুবার নাকি যোগাযোগ করেছে। সুস্থ বোধ না করার অভিযোগ করেছেন।

ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর এক প্রতিনিধিও দাবি করেছিল, বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটির দুর্ঘটনাস্থল শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু পরে এই তথ্য প্রত্যাখ্যান করেছেন ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান। ইরানি সংবাদমাধ্যমে এমন বেশ কয়েকটি বিভ্রান্তি ছিল।

কোনও সংকেত পাঠায়নি রাইসির হেলিকপ্টার: তুর্কি মন্ত্রী

তুরস্কের পরিবহনমন্ত্রী আব্দুলকাদির উরালোগলু বলেছেন, বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটির সংকেত পাঠানোর ব্যবস্থা বন্ধ ছিল বা তাতে এমন কোনও ব্যবস্থা ছিল না।

সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, বিমান চলাচলে জরুরি পদক্ষেপের ক্ষেত্রে তুরস্কের দায়িত্বের আওতাধীন অঞ্চলের মধ্যে পড়ে ইরান। হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনায় পড়ার খবর পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ যাচাই করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমরা মনে করি হয়তো সংকেত ব্যবস্থা বন্ধ ছিল অথবা এতে কোনও সংকেত ব্যবস্থা ছিলই না।

তদন্তের নির্দেশ সেনাপ্রধানের

ইরানের সেনাবাহিনী প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরানের বার্তা সংস্থা ইসনার খবরে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের কারণ তদন্ত করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন।

তদন্তে সহযোগিতা করবে রাশিয়া

প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হারানোর মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার তদন্তে ইরানকে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। দেশটির নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি সের্গেই শোইগু বলেছেন, হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় ইরানকে সহায়তা করতে প্রস্তুত মস্কো।

এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই ঘটনায় ইরানের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দেশটিকে নিজেদের সত্যিকারের বন্ধু বলে উল্লেখ করেছে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ইরানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করেছেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, গতকালের দুঃখজনক ঘটনার মূল কালপ্রিট হলো যুক্তরাষ্ট্র। যাদের নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরান উড়োজাহাজ ও উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ কিনতে পারছে না। এর ফলে ইরানি জনগণ ভালো মানের বিমান চলাচলের সুযোগ পাচ্ছেন না।

কী বলছে ইসরায়েল?

রাইসির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার বিষয়ে ইসরায়েল সরকার এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। তবে এক সরকারি কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, এই দুর্ঘটনায় ইসরায়েলের কোনও হাত ছিল না।

ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাইসির মৃত্যুর পেছনে ইসরায়েলের জড়িত থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ ইসরায়েল কখনও কোনও রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার দিকে যায়নি। এমন কিছু করতে যাওয়া মানে নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধ শুরু করা এবং ইরানের তরফে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পথ তৈরি করা।

উচ্ছ্বাস ইসরায়েলিদের

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন রাজনীতিকের মন্তব্যে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু নিয়ে ব্যঙ্গ করতেও দেখা গেছে। রাইসির মৃত্যুর পর ইরানের নীতি নিয়ে ইসরায়েল বেইতেনু দলের চেয়ারম্যান অ্যাভিগদর লিবারম্যান বলেন, আমি মনে করি না রাইসির মৃত্যুর পর এই অঞ্চলে ইরানের নীতির কোনও পরিবর্তন আসবে। ইরানের নীতি নির্ধারণ হয় তাদের সর্বোচ্চ নেতার (আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি) মাধ্যমে। একইভাবে এই ঘটনার পর ইসরায়েলের অবস্থারও পরিবর্তন হবে না।

তিনি আরও বলেছেন, কোনও সন্দেহ নেই ইরানি প্রেসিডেন্ট একজন নৃশংস মানুষ ছিলেন। তার জন্য আমরা এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলব না।

ইসরায়েল ন্যাশনাল নিউজের এক খবরে বলা হয়েছে, ইরানি প্রেসিডেন্টের মৃত্যু ইসরায়েলের জনগণের জন্য ভালো খবর। সোমবার এই মৃত্যু উদযাপনে প্রার্থনা ও নাচের আয়োজন করা হয়েছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর অফিসের ডেপুটি মিনিস্টার আভি মাওজ বলেন, একমাসের কম সময় আগে তিনি (রাইসি) হুমকি দিয়েছিলেন, ইসরায়েল যদি আক্রমণ করে তাহলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। এখন সেই তিনিই ইতিহাসের ধূলিকণা হয়ে গেলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *