চট্টগ্রাম

পুরনো দ্বন্দ্বের বলি ‘বড়’ বেলাল!

পুরনো দ্বন্দ্বের বলি ‘বড়’ বেলাল!

বাবুল, মিজান ও বেলাল। তিনজনই চট্টগ্রাম নগরের ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মিজান ও বেলালের মধ্যকার সম্পর্ক বন্ধুত্বের। কিন্তু বাবুলের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব। আর পুরনো সেই দ্বন্দ্বের জেরেই বাবুল গ্রুপের হাতে খুন হলেন মো. বেলাল— এমন দাবি পরিবারের। তবে ঠিক কী বিষয় নিয়ে খুনের দিনের ঘটনার সূত্রপাত তা এখনো রয়ে গেছে ধোঁয়াশা। পুলিশসহ স্থানীয় কিছু সূত্র বলছে, গাছ থেকে ডাব পাড়া নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত।

নগরের খুলশী থানার ঝাউতলাবাজার ও নালাপাড়া এলাকায় রবিবার (২৮ জানুয়ারি) সরেজমিন অনুসন্ধান এবং পুলিশের সাথে কথা বলে মিলেছে এসব তথ্য।

এর আগে, গতকাল (শনিবার) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঝাউতলা রেলস্টেশন এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় মো. বেলাল প্রকাশ বড় বেলালকে (৩২)। তিনি একই এলাকার রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দা। তার দুটি ছেলে ও একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। পেশায় তিনি ছিলেন একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক।

এদিকে, খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রায়হান (১৯) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে এখনো অধরা রয়ে গেছে মূল হোতারা।

ছুরির মুখে বাঁশ উচিয়ে জীবনরক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা

খুলশী থানা থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটারের দূরত্বে ঝাউতলা রেলওয়ে স্টেশন। রবিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের একপাশে ঝুপড়ি টং দোকানের সারি এবং অপরপাশে টিন দিয়ে ঘেরা বস্তিসদৃশ বসতঘর। রেলস্টেশনের প্লাটফর্মেই ছুরিকাঘাত করা হয় অটোচালক বেলালকে। সেখানে ঝরে পড়া রক্তের দাগ শুকিয়ে বিবর্ণ। প্লাটফর্মের পাশেই দাঁড় করিয়ে রাখা একটি শুকনো বাঁশ। সেই বাঁশেও স্পষ্ট রক্তের দাগ। মূলত এই বাঁশ দিয়েই আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিলেন বেলাল।

সকালের দিকে সেখানকার কয়েকটি দোকান খোলা থাকলেও বেশিরভাগই ছিল বন্ধ। আশপাশের বাসিন্দারা স্টেশনের প্লাটফর্মের পাশে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। তবে সবার মনেই শনিবার রাতের খুনের ঘটনা নিয়ে চাপা আতঙ্ক। চুপিসারে নিজেরা নিজেরা কথা বললেও সরাসরি মুখ খুলতে রাজি নন স্থানীয়দের অনেকে। রাজনৈতিক এবং পুলিশি হয়রানির আশঙ্কা তাঁদের মনে।

হামলা চালায় কিশোর গ্যাং

প্লাটফর্মের আশেপাশের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেন সিভয়েস২৪-এর সঙ্গে। তাঁর দাবি— বাবুল গ্রুপই স্থানীয় যত ঝামেলার প্রধান কারণ। আর তার অধীনে থাকা কিশোর গ্যাং সদস্যরাই কুপিয়েছে বেলালকে।

তিনি বলেন, ‘‘মূলত মিজান গ্রুপের ছেলেদের সাথে বাবুল গ্রুপের ঝামেলা হয়েছে। যাকে নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত তার নাম আরিফ। সে মিজান গ্রুপের। আরিফকে নালাপাড়ার বাবুল গ্রুপের বাবুলের শালা আকাশ মেরেছে। এরপর মিজান বেলালকে কল দিয়ে বলে, ‘দোস্ত আমার পোলাপানরে মারছে একটু আয়।’ এরপরে মিজান, বাবুল আর বেলাল মিলে একসাথে বসে বিষয়টা সমাধানও করছে। এরপর যে যার মতো চলে গেছে।’’

তিনি বলেন, ‘অনেকক্ষণ পর কিরিচ-ছোরা নিয়ে বাবুল গ্রুপের ছেলেরা আসছে অনেকগুলো। এসে মিজানকে খুঁজছে। কিন্তু মিজানকে না পেয়ে বেলালকে জিজ্ঞেস করছে— মিজান আমাদের ছেলেদের চড় মারছে কেন? এগুলো বলতে বলতে বেলালকে ধাক্কা দিয়ে অনেকদূর নিয়ে যায়। সবাই ছিলো কিশোর বয়সী। এরপর এখানে একটা ঘরের কোণায় বেলালকে ফেলে মুখ চেপে ধরসে ওই ছেলেগুলো। বেলালের হাতে একটা বাঁশ ছিলো। সে ওটা দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও তারা ছুরি দিয়ে বেলালকে উপর্যুপুরি আঘাত করেছে।’

‘এখানে যত ঝামেলা হয় বা হয়েছে সব ঝামেলার মূলহোতা নালাপাড়ার বাবুল। আর নাইলে মিজান বলি বা এই যে মারা গেল বেলাল—এদের কেউই ঝামেলা করার লোক না’- বলেন তিনি।

তিনজনই সাবেক কাউন্সিলরের অনুসারী

খুনের পেছনে অভিযুক্ত হিসেবে নাম উঠে আসা বাবুল কিংবা খুনের শিকার বেলাল এবং তার বন্ধু রুবেল— তিনজনই এলাকায় পরিচিত ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরনের অনুসারী হিসেবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ওই তিনজনেরই ছিল আলাদা আলাদা স্থানীয় গ্রুপ।

নিহত বেলালের মামা এবং স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, ‘বাবুল, মিজান আর আমাদের বেলাল তিনজনই হিরন সাহেবের অনুসারী। সবাইতো আওয়ামী লীগ করে। হিরন সাহেব এখন কাউন্সিলর না থাকলেও বেলাল তার গ্রুপ ছাড়েনি। সব পরিস্থিতে সাপোর্ট করেছে।’

নিহত বেলালের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘বাবুলরাও আওয়ামী লীগ করে আমার স্বামীও আওয়ামী লীগ করে। হিরন ভাই সব জানে। ওনারা সবাই হিরন ভাইয়ের রাজনীতি করে। আমার খালি একটাই দুঃখ। আমার স্বামীকে কেন খুন করা হলো? এখন শান্তনা দিলেও তো আমার স্বামী ফিরে আসবে না।’

গাছ থেকে ডাব পাড়াকে কেন্দ্র করেই খুন!

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরনের অধীনেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরব উপস্থিতি ছিল নিহত বেলালের। সাবেক এই কাউন্সিলর বলছেন— ঘটনার সূত্রপাত ডাব পাড়াকে কেন্দ্র করে।

তিনি সিভয়েস-২৪কে বলেন, ‘তারা আমার অনুসারী বলতে তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক। আমিও আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। শনিবার রাতে ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনার পর আমি সকালে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে স্থানীয় অনেকজনের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। যতটুকু জেনেছি, যেখানে বেলাল খুন হয়েছেন তার বিপরীতে একটি মাদরাসা আছে। আর সেই মাদরাসা থেকে ডাব পাড়াকে কেন্দ্র করেই খুনের ঘটনা ঘটেছে।’

অবুঝ ছেলে-মেয়েরা বাবার ফেরার অপেক্ষায়

খুনের শিকার মো. বেলালের ঘরে রয়েছে তিন সন্তান। ১১ বছর বয়সী বড় ছেলে তানভীর, তামিম (৬) এবং মাত্র ৬ মাসের মেয়ে বিথী। বেলালের রেলওয়ে কলোনির বাসায় গিয়ে দেখা যায়, অবুঝ শিশু তামিম খেলছিল বন্ধু বান্ধবদের সাথে। সে এখনো জানে না তার বাবা আর ফিরে আসবে না। সে শুধুই জানে তার বাবা অসুস্থ।

মাদরাসা পড়ুয়া তানভীর বেশি কিছু না বুঝলেও সে জানে বাবা আর ফিরে আসবেন না। চোখের পানি ফেলে সে বলতে থাকে, ‘আমার আব্বুর সাথে শনিবার সন্ধ্যায় শেষ কথা হয়েছে। আমাকে মোবাইল দিয়েছিলেন গেমস খেলতে। এরপর বেরিয়ে গেছেন বাসা থেকে। আমার আব্বু আর আসবেন না, আমাকে আদর করবেন না। এটা ভাবতেই পারছি না। আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’

‘আমার তিনটা বাচ্চার বুক খালি করলো ওরা’

নিহত বেলালের স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের সাথে প্রতিবেদকের দেখা হয় খুলশী থানা প্রাঙ্গনে। বেলালের অবর্তমানে এখন পরিবারের অভিভাবক তিনিই। ক্ষুধা পেটে ৬ মাস বয়সী বিথীকে নিয়ে খুনের মামলা দায়ের করতে সকাল থেকে দৌড়ঝাপ করছেন থানায়। এ সময় তার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।

পুরনো শত্রুতার জেরেই খুন করা হয়েছে বেলালকে—এমন দাবি করে তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘কিছুদিন আগে এক মেয়ের স্বামীকে বাঁচাতে আমার স্বামী যায়। তখন স্বামীর মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে নালাপাড়ার বাবুল। সেই ঘটনারও বিচার আমি পাইনি। আমার স্বামীর সাথে ওদের পুরনো শত্রুতা।’

শনিবারের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘দুপুরে এসে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ভাত খাব। আমি তার প্রিয় মাছের ভর্তা বানিয়েছিলাম। খেয়ে-দেয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছিলো। এরপর ঘুমিয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে দুজন আসে বাসায়। একজনের বয়স ১২-১৩, আরেকজনের ১৭-১৮ বছর। এসে আমাকে বলে, বেলাল মামাকে একটু ডাকেন মামী। কেন জিজ্ঞেস করায় বলে, মিজান ভাই আমার অটো নিয়ে গেছে। মামাকে বলে অটোটা একটু এনে দেন। আমার স্বামী তাদের আশ্বাস দেয়।’

‘এরপর ৭টার দিকে একটা কল আসে। কে দিয়েছে জানি না। স্টেশনে একটা বিচার করার জন্য আমার স্বামীকে ডাকে। তিনি গিয়ে নাকি মীমাংসাও করে দিয়েছেন। কিন্তু তা নাকি বাবুলের মনমতো হয়নি। তাই তাকে প্ল্যান করে খুন করা হয়েছে। এখন আমরা সকাল থেকে থানায় মামলা করার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতেছি। পুলিশ মামলা নিচ্ছে।’

‘আমি ওরে (বেলাল) তিনবার কুমিল্লা নিয়ে গেছি। কিন্তু ও কুমিল্লা থাকবে না। চট্টগ্রাম চলে আসছে বন্ধুদের জন্য। এই বন্ধু বন্ধু কইয়া কইয়াই আমার স্বামীর প্রাণটা গেল। ওরা যদি স্বামীর হাত-পাও কেটে ফেলতো তাও বুঝতাম বেঁচে আছে। আমি তারে কাছে পাইতাম। এখন এইডা কি করলো ওরা? আমি এখন তিনটা ছেলে-মেয়ে নিয়ে একটা মহিলা কই যাব? আমার তিনটা বাচ্চার বুক খালি করলো ওরা। আমি ওদের কি ক্ষতি করছি?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে

খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেয়ামত উল্লাহ সিভয়েস-২৪কে বলেন, ‘বেলাল খুনের ঘটনায় গতকাল রাতেই অভিযান চালিয়ে আমরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচজনকে এনেছিলাম। যাচাই-বাছাই করে আমরা চারজনকে ছেড়ে দিয়েছি এবং রায়হান নামে একজনকে আটক করেছি। আমরা বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি খুনের বিষয়ে। ডাব পাড়া বা গাঁজা খাওয়া নিয়েই ঘটনার সূত্রপাত—এমন তথ্য আমরা পেয়েছি। আমরা যাচাই করছি। এই খুনের ঘটনায় জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’

এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রীর পক্ষ থেকে এজাহার দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান ওসি নেয়ামত উল্লাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *