চট্টগ্রাম

ভবিষ্যতের দিশা পেয়েছে সাড়ে ৭ হাজার এতিম-অসহায় মেয়ে

নাইমা জান্নাত (১৮)। আজ থেকে ১৩ বছর আগে বাবা মা হারা এতিম মেয়েটির জীবন অনেকটা অনিশ্চত হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় বড় বোন তাসলিমার সংসারে থাকতে হয় তাকে। কিন্তু বেশি দিন সেখানেও জায়গা হলো না তার। এমন অবস্থায় বেশ বিপদেই পড়েন তাসলিমা। মাত্র পাঁচ বছরের বোনটাকে কার কাছে রাখবেন! এমন দুচিন্তায় দিশেহারা তাসলিমা খোঁজ পান চট্টগ্রাম বালিকা সদনের। অনেকটা অন্ধকারে আলোর দিশা পান তিনি। এরপর এক যুগের বেশি সময় নাইমার ঠিকানা হয়ে উঠেছিল নগরীর আম বাগান ঝাউতলা এলাকার চট্টগ্রাম বালিকা সদনে। শেষ করেন স্কুল জীবন। ভর্তি হন কলেজে। পড়াশোনার পাশাপাশি এখন নাইমা নিজেও সেই বালিকা সদনের শিক্ষিকার হয়ে কর্মজীবন শুরু করেছেন। অনাত নাইমার মত দীর্ঘ ৪০ বছরের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে এমনই এতিম অসহায় সাড়ে ৭ হাজার মেয়ের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে এ কে খান ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম বালিকা সদন।

চট্টগ্রাম বালিকা সদন কর্তৃপক্ষ জানান, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চট্টগ্রামের অনাথ, অসহায়, এতিম মেয়েদের নিয়ে কাজ করছেন সংগঠনটি। এখানে ২শ জন মেয়ের থাকার জন্য আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিবছর স্বাবলম্বী হয়ে কিছু মেয়েকে বিদায় দেয়া হয়। সে জায়গায় স্থান হয় আরো কিছু মেয়ের। এসব মেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি দেয়া হয় বিভিন্ন রকম কর্মমূখী প্রশিক্ষণ। এছাড়া কারাতে, মাশালআর্ট প্রশিক্ষণ, রান্নাবান্নার, সেলাই, ব্লক-বুটিক, কম্পিউটার ট্রেনিংসহ দেয়া হয় বিভিন্ন রকম কর্মমুখী প্রশিক্ষণ। এসএসসি পাশের পর স্বনির্ভরশীল করে বিদায় দেয়া হয় মেয়েদের। এসময় প্রতিটি মেয়েকে ১২ হাজার টাকা, একটি সেলাই মেশিন দেয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রকৃতিক পরিবেশে ঘেরা পাহাড়ি এক বাংলোতে মনোরম পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে এতিম অসহায় মেয়েদের রাজ্য চট্টগ্রাম বালিকা সদন। পাহাড়ের রাস্তা বেয়ে উপরে উঠে দেখা যায় তালাবদ্ধ গেট। ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। তালাবন্ধ গেটের ভেতরে মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলছে কিছু মেয়ে। কেউ বসে সেই খেলা উপভোগ করছে। এর পাশেই রং তুলি নিয়ে ছবি আঁকছেন আরো কয়েকজন মেয়ে। ৫-১০ বছরের কিছু মেয়ে ছোটাছুটি করে খেলাধুলা করছে। তবে সন্ধ্যা নামতেই যে যার মত চলে যায় রিডিংরুমে। এমনই সুশৃঙ্খল ও মনোরম পরিবেশে বেড়ে উঠছে ২শ’ জনের এ পরিবার। এখান থেকে এইচএসসি পাশ করে পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছে তিন হাজারের বেশি মেয়ে। যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আবার দীর্ঘ ৪০ বছরে উদ্যোক্তা হয়ে স্বনির্ভরশীল হয়েছে দুই হাজারের বেশি মেয়ে।

আয়েশা আক্তার (ছদ্মনাম) বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেলে মা মারা যায়। এরপর বাবা আবার বিয়ে করে কোথায় চলে যায়। এশহরে কেউ নেই আমার। তাই রেল স্টেশনেই ভিক্ষা করতাম। পরে একটা এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখানে পুনর্বাসন করা হয়। পড়ালেখা শুরু করি। জিপিএ-৫ নিয়ে এসএসসি পাস করি। এখন আমি ওমেন কলেজে পড়ালেখা করছি। আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন আমার। এসএসসি পাশের পর আবার এখানেই শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেছি।

নাজমা কলি বলেন, বালিকা সদনে থেকে এইচএসসি পাশ করি। সেখানেই সেলাইয়ের কাজ, ব্লক-বাটিকের কাজ শিখেছি। পরবর্তীতে বিয়ে হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। এখন আমি স্বামী সন্তান নিয়ে পতেঙ্গা এলাকায় থাকি। এখানে একটি সেলাইয়ের দোকান দিয়েছি।

চট্টগ্রাম বালিকা সদনের সুপারিনটেনডেন্ট ফারহানা চেীধুরী বলেন, এখানে ৮০ ভাগ মেয়েই হচ্ছে এতিম এবং ২০ ভাগ মেয়ে রয়েছে হতদরিদ্র পরিবারের। যাদের বেশির ভাগের বাবা-মা কেউই নেই। বর্তমানে এ মেয়েদের মধ্যে ৪৮ জন মেয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা করে জন প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে। এছাড়া সম্পুন্ন প্রতিষ্ঠানটি চলে বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং ডোনারের সহায়তায়। এখানে মেয়েদের আশ্রয়ের পাশাপাশি পড়ালেখা, কারাতে, কম্পিউটার ট্রেনিংসহ বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যাতে তারা পড়ালেখার পাশাপাশি স্বনির্ভরশীল হতে পারে। এছাড়া ১৮ বছর পর তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এমন কোনো ব্যক্তির হাতে তাদের তুলে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে অনেকের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে চলে যায়, কেউ চাকরি নিয়ে চলে যায়, কেউ নিজেই উদ্যোক্তা হতে পারে এ জন্য ১২ হাজার টাকাসহ একটি সেলাই মেশিন দিয়ে বিদায় দেয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *