‘শূন্যের বৃত্ত’ থেকে বের হলো বে-টার্মিনাল প্রকল্প
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৬ সালে ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। এরপর গুনে গুনে কেটে গেছে ৮ বছর। নানা জটিলতায় ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম একটুও এগোয়নি। ফলে থমকে থাকে দেশের অন্যতম এই মেগা প্রকল্প। এ সময় মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও বন্দর কতৃপক্ষের মধ্যে শুধু চিঠি চালাচালিই হয়েছে। তবে অবশেষে সুখবর এসেছে। আলোর মুখ দেখছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প এই বে-টার্মিনাল প্রকল্প।
সম্প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষকে নামমাত্র মূল্যে জমি বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। মাত্র ৩ কোটি ৩ টাকায় ৫০০ একর জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রাক্কলন তৈরির জন্য জেলা প্রশাসনকে চিঠি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে উত্তর হালিশহর মৌজার জমি গত ৩০ জানুয়ারি এবং দক্ষিণ কাট্টলী, মধ্য হালিশহর দক্ষিণ হালিশহর মৌজার জমি ১১ ফেব্রুয়ারি বন্দোবস্ত দিতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়।
বন্দর সূত্র জানায়, নানা চিঠি চালাচালি শেষে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তিনভাবে বে-টার্মিনালের জায়গা বুঝে পেতে কাজ শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে মামলা ছাড়া ৫০০ একর অকৃষি খাসজমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত পায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া দক্ষিণ কাট্টলী মৌজায় বিভিন্ন আদালতে মামলাভুক্ত প্রায় ১৮৮ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়। বে-টার্মিনালের জন্য প্রস্তাবিত এলাকায় ২৬৭ একর সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে গেজেটভুক্ত জমি পাওয়া যায়। যদিও সেখানে বাস্তবে বনভূমি দূরে থাক, ভালো করে গাছও নেই। এসব জমি বন বিভাগ সরেজমিনে তদন্ত করেও বনের অস্তিত্ব পায়নি। বর্তমানে এসব জমি ডি গেজেটভুক্ত অর্থাৎ গেজেট থেকে অবমুক্ত করে খাস জমি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করার জন্য ফাইল মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে। খাস জমি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হলেই জমিগুলো পুনরায় বন্দোবস্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বে-টার্মিনাল বাস্তবায়নে মোট ৩ ভাবে জমি বুঝে নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে খাস খতিয়ানভুক্ত ৫০০ একর জমি আমাদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা নামমাত্র মূল্যে এসব জমি বরাদ্দ পেয়েছি। এছাড়া মামলাভুক্ত জমি আমরা অধিগ্রহণ এবং সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে গেজেটভুক্ত জায়গাগুলো ডি গেজেট করে বরাদ্দ পেতে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সবমিলিয়ে বে-টার্মিনাল বাস্তবায়নে ভূমি সংক্রান্ত যেটি জটিলতা ছিল, সেটি অনেকটা কেটে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর ৮২০ দশমিক ৫৫৭৫ একর জমি বরাদ্দ পেতে প্রস্তাবনা দেয় চট্টগ্রাম বন্দর। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন দুটি বন্দোবস্ত মামলা সৃজন করে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। এ সময় বন্দোবস্তের আনুমানিক মূল্য ধরা হয় ১০ হাজার ২১৮ কোটি ২২ লাখ ৩২ হাজার ৩০১ টাকা। এরপর ভূমি মন্ত্রণালয় মামলা-মোকদ্দমা এড়াতে খাস জমি অধিগ্রহণের পরামর্শ দেয়। এতে করে বন্দোবস্ত ফাইল দুটি চট্টগ্রামে ফেরত আসে।
এদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৮ সালের ১০ জুলাই জেলা প্রশাসন বরাবর ৮০৩ দশমিক ১৭১০ একর ভূমি অধিগ্রহণে প্রস্তাবনা দেয়। এর মধ্যে ৮০২ দশমিক ৩৮৩৫ একর খাস এবং শূন্য দশমিক ৭৮৭৫ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি রয়েছে। জেলা প্রশাসন হয়ে সেই প্রস্তাবনা আবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের চলে যায়। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ কেন্দ্রীয় ভূমি কমিটির ১২০তম সভায় অধিগ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
একই বছরের ১৩ নভেম্বর জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ মামলা সৃজন করে এবং এর মূল্য ধরা হয় ৩ হজার ৫৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৪১ টাকা। তবে বন্দর এসব অধিগ্রহণের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং প্রতীকী মূল্যে জমি বরদ্দ দিতে আবেদন করেন। এরপর ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রতীকী মূল্যে খাস জমি বরাদ্দ নিতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ প্রস্তাব বাতিল করে বন্দোবস্ত প্রস্তাব প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়। এরপর তিনটি বন্দোবস্ত মামলা দায়ের করে ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে জেলা প্রশাসন। ৭৯১ দশমিক ৭৮৩৫ একর খাস জমির সেলামি মূল্য ধরা হয় ১১ হাজার ১০০ কোটি ৮০ লাখ ৬৮ হাজার ২৫১ টাকা। ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর পুনরায় নামমাত্র মূল্যে ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর বে-টার্মিনালের জন্য অকৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়ার বিষয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বে-টার্মিনালকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার তিনটি নথি ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে নতুন করে মামলাভুক্ত এবং নিষ্কণ্টক জমি আলাদা করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নিষ্কণ্টক জমি বন্দোবস্তের মামলা দায়ের এবং মামলাভুক্ত জমি অধিগ্রহণ করতে সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই মূলত জটিলতা কেটে প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি বরাদ্দ পায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে নগরের পতেঙ্গা ও হালিশহর সমুদ্র উপকূলভাগে বিস্তীর্ণ ভূমি এবং সাগরঘেঁষে বে-টার্মিনাল নির্মাণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রকল্পটির উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা জানান, বে-টার্মিনাল হলে প্রায় ১২ মিটার ড্রাফট (পানির ভেতরে থাকা জাহাজের অংশ) এবং যেকোনো দৈর্ঘের জাহাজ এখানে ভেড়ানো যাবে। যেখানে বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর জেটি-বার্থে ভিড়তে পারছে সর্বোচ্চ ১০ মিটার ড্রাফট এবং ২০০ মিটার দৈর্ঘের জাহাজ।
এছাড়াও বে-টার্মিনালে একইসঙ্গে ভিড়তে পারবে ৩৫ থেকে ৫০টি জাহাজ। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা করতে হলেও বে-টার্মিনালে এ জটিলতা থাকবে না। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের জট অনেকাংশে কমে যাবে। খরচ কমে গতি আসবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। বে-টার্মিনাল চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুগুণ বাড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯৪ ভাগ আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। আবার মূল রপ্তানি বাণিজ্যের ৯৮ শতাংশ এ বন্দর দিয়ে হয়। প্রতি বছর জাহাজ, কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়তে থাকায় তা সামাল দেওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এজন্য সক্ষমতা বাড়াতে নতুন প্রকল্প হাতে নিতে হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে।