জাতীয়

সম্পর্কের ব্যাপ্তি বাড়াতে আগ্রহী ঢাকা ও ওয়াশিংটন

পশ্চিমা বন্ধুদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপ্তি বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দুই দেশের চলমান অংশীদারত্ব আরও সম্প্রসারণ করার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। যার ভিত্তিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে ঢাকার পক্ষ থেকে আগ্রহের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।

ঢাকাও চায় যে অদূর ভবিষ্যতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় হোক। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে যে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকাও ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে চায়। ঢাকা চায় যে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করুক, যাতে তারা সরেজমিন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে এবং ঢাকার সক্ষমতা সম্পর্কে সরাসরি জানতে পারে। অন্যদিকে হোয়াইট হাউসও ঢাকার উচ্চ পর্যায়ের সফর প্রত্যাশা করে।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম, নিরাপত্তা, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, জলবায়ু সংকট এবং রোহিঙ্গা সংকটসহ সম্পর্কের পাঁচটি প্রধান খাতকে গুরুত্ব দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র এবং সম্পর্ক আরও প্রসারিত করতে চায়। ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে কোন কোন খাতে কীভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া যায়, কৌশল কী হবে ইত্যাদি বিষয় চিহ্নিত করতে গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বাণিজ্য-বিনিয়োগ, জলবায়ু সংকট, মেরিটাইম, সামরিক খাত, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং রোহিঙ্গা সংকটকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টরা পরামর্শ দেন। সে সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে দুই পক্ষের সম্পর্কে যেসব অস্বস্তি বা ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে-প্রথমে তা দূর করতে হবে। শুধু তাই নয়, ভুল বোঝাবুঝির উৎস চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে এ অঞ্চলের সংস্কৃতির পার্থক্যটা তুলে ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে ঢাকার কূটনীতিকদের বেশি পরিশ্রম করতে হবে।

পশ্চিমা এই দেশ ঢাকাকে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে চায়। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বৈশি^ক কৌশল বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে নিবিড়ভাবে পাশে চায়। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ম্যাক্সওয়েল মার্টিন গত বৃহস্পতিবার নির্বাচিত কিছু গণমাধ্যমকর্মীদের এক ব্রিফিংয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় যে বাংলাদেশ নিজের ও এ অঞ্চলের (দক্ষিণ এশিয়া) অন্য দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালনকারী দেশ হিসেবে ভূমিকা রাখুক। যাতে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে। আর এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা প্রস্তুত।

যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, এ অঞ্চলের সব দেশের নিজেদের সুরক্ষা এবং অন্যদের সহায়তা করার সক্ষমতা থাকা উচিত। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন ধরনের টেকসই এবং ইতিবাচক নিরাপত্তা কাঠামো দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে বাংলাদেশের উদ্যোগ নেওয়া ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করে থাকে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ নিজেদের সক্ষমতা অনেকাংশেই বাড়াতে সক্ষম হয়েছে, যা এ অঞ্চলে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্রও নিজেদের মধ্যে গর্ব অনুভব করে।

পশ্চিমা বন্ধু দেশটি চায় যে জিসমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট) এবং আকসা (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিং এগ্রিমেন্ট) নামের দুটি সামরিক চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দিক বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। সবশেষ গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নবম নিরাপত্তা সংলাপে বিষয়টি আলোচনা করা হয়। চলতি বছরের শেষদিকে ওয়াশিংটনে দুই পক্ষের মধ্যে দশম নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সংলাপে বিষয়টি আলোচনায় উঠতে পারে।

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নে যেসব রাষ্ট্রের সমর্থন প্রয়োজন সেসব রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়ে কাজ করছে ওয়াশিংটন। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুবই সিরিয়াস বিষয়। এ কৌশলে এবং একই সঙ্গে চীনকে প্রতিহত করতে বাংলাদেশকে নিবিড়ভাবে পেতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় ঐকমত্যের (শুধু রাজনৈতিক নয়, দেশের সব পেশাজীবীদের সমন্বয়) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং ঢাকায় দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৮ মে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং বৃহত্তম রফতানি গন্তব্যের দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, পাশাপাশি দ্বৈতকর এড়ানোর জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ছিল ২৬১ মিলিয়ন ডলার। গত ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করে এবং বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রফতানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্য (শস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম এবং ভুট্টা), যন্ত্রপাতি এবং লোহা ও ইস্পাত পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে পোশাক, জুতা, বস্ত্রজাত পণ্য এবং কৃষিজাত পণ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *