চট্টগ্রাম

সৈকতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি

সৈকতে ঢোকার মুখে সারি সারি দোকান। মূল সড়ক থেকে সমুদ্রের পাড়ে নামতে হয় এসব দোকানের পাশের সরু পথ ধরে। সেখানে গিয়েও দাঁড়ানোর জো নেই। দোকান বরাবর ছাতা পুঁতে সেখানে চেয়ার বসিয়ে রাখা। তাঁর সঙ্গে যোগ হয় অস্বাস্থ্যকর খাবারের পোড়া গন্ধ। চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের অবস্থা এখন এমন। সমুদ্র-দর্শনে গিয়ে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছেন দর্শনার্থীরা।

সৈকতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তালিকাভুক্ত দেড় শ দোকান থাকলেও এখন অবৈধভাবে আরও অন্তত ছয় শ দোকান বসানো হয়েছে। দোকানিদের বেচাকেনা করতে দৈনিক ভিত্তিতে দিতে হয় চাঁদা। দোকানগুলোয় প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪০ লাখ টাকার চাঁদা তুলছে একটি চক্র, যা বছরে দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো। চাঁদা আদায়কারীরা সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

পতেঙ্গা সৈকতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক বেড়াতে আসেন। ছুটির দিনের এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হয়। কিন্তু সৈকতের পরিবেশ দেখে হতাশ হতে হয় তাঁদের। সৈকত ঘিরে অবৈধ দোকান বসানো এবং চাঁদা আদায়ের ঘটনা চলতে থাকলেও তা বন্ধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই।

সিডিএ আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত সিটি আউটার রিং রোড সড়ক নির্মাণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করে সিডিএ। তখন সৈকতে প্রশস্ত সড়ক এবং বাগান করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে বাগানের ওপর দোকানগুলো বসে যায়।

জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, এখানে তালিকাভুক্ত দোকানির বাইরে সবাই অবৈধ। এগুলো উচ্ছেদ করা হবে।

সরেজমিনে ঘুরে ও দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৈকতে বর্তমানে খাবার, গয়না, খেলনাসহ বিভিন্ন রকমের প্রায় সাড়ে সাত শ দোকান রয়েছে।

দোকানি, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও দোকান মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার থেকে পাঁচ বছর ধরে এসব দোকান বসানো হয়। সৈকত এলাকায় ব্যবসা করতে গেলে বৈধ-অবৈধ সব দোকানকে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়। দোকান ও আয়তনের ধরনভেদে প্রতিদিন গড়ে সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

দোকানিরা জানান, পতেঙ্গায় অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে স্থানীয় দোকান মালিক সমিতি, হকার্স সমিতি, স্পিডবোট সমিতির সদস্যরা জড়িত। এর মধ্যে ওয়াহিদুল আলম ওরফে ওয়াহিদ মাস্টার, নুর মোহাম্মদ, তাঁর ছেলে মাসুদ করিম এবং মোহাম্মদ মুসার নেতৃত্বে চাঁদা তোলা হয়। তাঁদের মধ্যে নুর মোহাম্মদ ও তাঁর ছেলে মাসুদ করিমের রাজনৈতিক সংগঠনে কোনো পদ না থাকলেও নিজেদের স্বেচ্ছাসেবক লীগের ‘নেতা’ হিসেবে পরিচয় দেন। মোহাম্মদ মুসা ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি এবং ওয়াহিদুল আলম ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

এই চাঁদা আদায় নিয়ে দুটি পক্ষ সক্রিয় আছে। তবে উভয় পক্ষ চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে দায় চাপিয়েছে অপর পক্ষের কাঁধে। সৈকতে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশ দোকানির অভিযোগ হকার্স সমিতির নেতা মাসুদ করিমের বিরুদ্ধে। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য এম এ লতিফের নাম ব্যবহার করে এসব চাঁদা তোলেন বলে দাবি তাঁদের।

তবে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পতেঙ্গা হকার্স সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ করিম। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু সমিতির চাঁদা বাবদ ২০ টাকা করে নিই। মূলত ওয়াহিদ মাস্টার ও মুসা অবৈধ দোকান, মাদকসহ বিভিন্ন বাণিজ্য করত। তাঁদের সৈকত থেকে তুলে দেওয়ায় তাঁরা আমার নামে এসব রটাচ্ছে।’

তবে একসময় দোকানগুলো থেকে চাঁদা আদায়ের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন তা করছেন না বলে দাবি করেন পতেঙ্গা সি-বিচ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ওয়াহিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বছর ধরে কোনো চাঁদা তুলছি না। এর আগে ২০ থেকে ৫০ টাকা নিতাম। বর্তমানে হকার্স সমিতির মাসুদই টাকা তোলে।’

গত রোববার পতেঙ্গা সৈকত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সৈকতের খেজুরতলা এলাকা থেকে নেভাল একাডেমির আগপর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে দোকান। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য করা বাগানগুলোও দখল করে বসানো হয়েছে চেয়ার-টেবিল।

সৈকতে প্রবেশপথের পাশেই নাগরদোলা, চরকাসহ বিভিন্ন রাইড। ভাটার সময় সৈকতের বালুচরেই বসছে দোকান। সৈকতে ঘুরতে আসা নগরের আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা আশিকুর রহমান বলেন, সৈকতে পদে পদে উৎপাত। দোকান আর দোকান, চেয়ার-টেবিল আর পার্কের মতো শিশুদের রাইড। খাবারের দোকানে দাম আকাশছোঁয়া। স্পিডবোট ও ক্যামেরাম্যানরাও জোর করে বাড়তি টাকা নেন। পাড়ে থাকা চেয়ারগুলোয় বসলেও টাকা দিতে হয়।

দোকান করার জন্য চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অন্তত ১০ জন দোকানি। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁরা বলেন, দোকান বসাতেও এককালীন ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়।

ট্যুরিস্ট পুলিশের পতেঙ্গা সাব জোনের ইনচার্জ মোহাম্মদ ইসরাফিল মজুমদার বলেন, স্থানীয় দুটি সমিতির লোকজন চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি, বন বিভাগ চাইলেই অভিযান চালিয়ে অবৈধ দোকান তুলে দিতে পারে।

পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে অবৈধ দোকান স্থাপন এবং নাম ব্যবহার করে চাঁদা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য এম এ লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নাম ব্যবহার করা হলেও তারা কেউ আমার অনুসারী নয়। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়েছি।’

জানা গেছে, প্রায় দেড় বছর আগে সৈকত এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল। এরপর আর কোনো তদারকি হয়নি। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সৈকতে কোনো চাঁদাবাজি বা অবৈধ ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না। দোকানিদের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। সেটিও হবে সৈকত থেকে দূরে। সৈকতের পাশে কোনো দোকান থাকবে না। সৈকত হবে উন্মুক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *