চট্টগ্রামলোহাগাড়া

৩ লাখ দিয়ে শুরু মুরগি পালন, বর্তমানে ৫ কোটি টাকার মূলধন!

৩ লাখ দিয়ে শুরু মুরগি পালন, বর্তমানে ৫ কোটি টাকার মূলধন!

২৭ বছর আগের কথা। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার তৈয়ব তাহের তখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শখের বশে নিজের বাড়িতে ৫০টি দেশি মুরগি পালন শুরু করেন মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ তৈয়ব। অভিজ্ঞতা না থাকায় সেইবার অধিকাংশ মুরগি মারা যাওয়ায় মোটা অংকের লোকসান গুনেন তিনি।

এতে কিছুটা হতাশ হন তৈয়ব, কিন্তু দমে যাননি। ১৯৯৮ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ঢাকা ক্যাম্পাস থেকে স্নাতক শেষ করেন তৈয়ব। এরপর উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে ২০০০ সালে প্রবাসী বড় ভাইয়ের টাকায় প্রথমবারের মতো মুরগির খামার শুরু করেন তিনি। প্রারম্ভিক মূলধন ছিল ৩ লাখ টাকা। বর্তমানে ৩৫টি খামার মিলে তার মূলধন প্রায় ৫ কোটি টাকা।

তৈয়ব তাহেরের বাড়ি লোহাগাড়া সদর ইউনিয়নের সাতগরিয়া পাড়া এলাকায়। বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দুরে দরবেশ হাট রাস্তার মাথা এলাকায় পৈত্রিক ৩২ শতক জমিতে ২০০০ সালে প্রথম খামার গড়ে তোলেন তিনি।

একই বছর প্রথমবারের মতো ৩ হাজারটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা পালন করে খামারটির যাত্রা শুরু করেন তৈয়ব। দেড় মাস পালনের পর মুরগি বিক্রি করে ৭৫ হাজার টাকা আয় করেন তিনি। পরের বছর ২০০১ সালে আরও দুটি ব্রয়লার মুরগির খামার চালু করেন। ওই দুটি খামারে আরও সাড়ে তিন হাজার মুরগি পালন করে বিক্রি করেন। লাভের পরিমাণ হয়ে যায় আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ।

অভিজ্ঞতার সাথে সাথে অনুপ্রেরণা বাড়তে থাকে তৈয়বের। গড়ে তোলেন একের পর এক খামার। সময়ের সাথে সাথে তার খামারের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বর্তমানে একটি দুটি নয়, গুনে গুনে ৩৫টি খামারের মালিক তৈয়ব। যা উপজেলার মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ।

তৈয়বের এসব খামারের অবস্থান উপজেলার চুনতি, পুটিবিলা, লোহাগাড়া সদর ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে। এম এস এগ্রো ফার্ম নামে এসব খামার পরিচালিত হয়। খামারগুলোতে কাজ করছেন ৫২ জন শ্রমিক।

সম্প্রতি লোহাগাড়া থানাধীন রাস্তার মাথা এলাকায় তৈয়বের একটি লেয়ার মুরগির খামার ঘুরে দেখা যায়, পাশাপাশি টিনশেডের সাতটি ঘরে ১০ হাজার লেয়ার মুরগি ডাকাডাকি করছে। প্রতিটি ঘর জাল দিয়ে ঘেরা। খামারে হেঁটে হেঁটে প্লাস্টিকের থালাতে ডিম সংগ্রহ করছেন তৈয়ব। পাশাপাশি খামারে নিয়োজিত শ্রমিকদের দিচ্ছেন খামার পরিচর্যা বিষয়ক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় বাজারগুলোর মাংস ও ডিমের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের যোগান আসছে তৈয়বের খামার থেকে। নিজের ৩৫টি খামারের মধ্যে ২৪টিতে ৩৫ হাজার ব্রয়লার, ৭টিতে ১৫ হাজার লেয়ার এবং বাকি ৪টি খামারে ১০ হাজার সোনালি জাতের মুরগি পালন করছেন তৈয়ব। তার উৎপাদিত ডিম ও মুরগি উপজেলার অন্তত ১০টি বাজার ও চট্টগ্রাম শহরে বিক্রি হয়। এতে প্রতি মাসে গড়ে তৈয়বের আয় ৬ লাখ টাকা।

খামার পরিচালনার পাশাপাশি তৈয়ব নেতৃত্ব দিচ্ছেন খামারিদের সংগঠনেও। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দুবছর ধরে। পোল্ট্রি ফিড ব্যবসায়ী সমিতির চট্টগ্রাম দক্ষিণ, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ৭ বছর ধরে। ২০১৫ ও ২০১৭ সালে ভারতের মাদ্রাজ ও ত্রিপুরায় পোল্ট্রি বিষয়ক দুটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৬ ও ২০১৮ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি মেলায় যোগ দেন তৈয়ব।

৫১টি গরু ও বকনা নিয়ে দুগ্ধ খামারের যাত্রা শুরু করেন তৈয়ব। বর্তমানে তার খামারে দৈনিক একশো লিটার দুধ উৎপাদিত হয়, যা পর্যায়ক্রমে দৈনিক তিন শতাধিক লিটারে উন্নীত হবে বলে আশাবাদী তিনি।

তৈয়ব তাহের একুশে পত্রিকাকে বলেন, পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করার ইচ্ছা কখনোই ছিল না। তাই আজ আমি একজন সফল উদ্যোক্তা। মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণ করে এই অঞ্চলকে একটি স্বনির্ভর অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখতে চাই।

তৈয়ব তাহের জানান, ব্যবসায়ীরা খামারে এসে ডিম ও মুরগি নিয়ে যান। সাধারণ ক্রেতারাও বাজার থেকে কিছুটা কম মূল্যে ডিম ও মুরগি কিনতে নিয়মিত খামারে আসেন।

তৈয়ব আরও বলেন, নতুন খামারিদের সরেজমিন গিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিই। ভবিষ্যতে যারা উদ্যোক্তা হবেন, তাদেরও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিব। এতে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেকারত্ব কমবে। একটি আত্মনির্ভরশীল জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সরকারের কাছে আমার দাবি, যে হারে মুরগির বাচ্চা, মেডিসিন ও খাবারের দাম বেড়েছে, সেই হারে মুরগি ও ডিমের দাম বাড়েনি। এক্ষেত্রে সমন্বয় জরুরি। খামারিদের সহজ শর্তে কৃষি ঋণ প্রদান করতে হবে। নইলে নতুন ও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঠিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এ এম খালেকুজ্জামান একুশে পত্রিকাকে বলেন, তৈয়ব তাহের প্রান্তিক খামারি থেকে নিজের মেধা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আজ উপজেলার সবচেয়ে সফল ও বড় খামারি। তার খামারের মুরগি ও ডিম স্থানীয় বাজারের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করছে। আমাদের পরামর্শ মেনে চললে যে কেউ খামার করে তৈয়বের মতো সফল হতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *