প্রাণহীন কোহেলিয়া, প্রায় চার হাজার জেলের কাজ নেই
প্রায় ৪ হাজার জেলে পরিবারের বসতি কোহেলিয়াকে ঘিরে। মহেশখালী দ্বীপের নাব্যতা হারিয়ে ফেলা একটি নদীর নাম কোহেলিয়া। নদীতে জল নেই তাই মাছও নেই; জেলেদের আয় নেই। নাব্যতা হারাতে হারাতে কয়েক বছরে অনেকটা মরেই গেছে কোহেলিয়া।
জেলেরা বলেছেন, ২০১৬ সালের পর থেকে কোহেলিয়া নদী ভরাট হতে শুরু করে। কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের বর্জ্য ও পলিমাটি সরাসরি নদীতে এসে পড়ে। যার কারণে নদী দ্রুত ভরাট হয়ে গেছে। আগে নদীতে জাল ফেললেই মাছ পাওয়া যেত, এখন সেই মাছের দেখা নেই।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সংসারের খরচ মেটাতে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় চলে গেছেন এখানকার জেলেরা। মাছ নেই তাই বদলে গেছে পেশা। তাদের কেউ এখন জাহাজ শ্রমিক, কেউ দিনমজুর, কারও কোন পেশাই নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দালন (বাপা) মহেশখালী শাখার সভাপতি মোছাদ্দেক ফারুকী বলেছেন, কোহেলিয়ার মৃত্যুতে জেলে পরিবারে হাহাকার চলছে। অনেক জেলে সীতাকুণ্ড গিয়ে জাহাজ ভাঙ্গার কাজ নিয়েছে। এই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণেই কোহেলিয়া ভরাট হয়ে এখানকার মানুষের জীবনে কষ্ট নেমে এসেছে। এখন নদীতে মাছ ও মাছের পোনা পাওয়া যায় না। নদীর বুক ছিড়ে প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য ব্রিজ ও রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে নদী আরো দ্বিগুণ গতিতে ভরাট হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জেলেদের দুঃসময়ে স্থানীয় কোন জনপ্রতিনিধি সহযোগিতা করছে না। প্রকৃত জেলেরা সরকারি সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত। আর নদী রক্ষায় স্থানীয়রা আন্দোলন করলেও নিশ্চুপ ভূমিকায় থাকে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজন।
মহেশখালী জনসুরক্ষা কমিটির সভাপতি নুর মুহাম্মদ বলেন, ‘পলি জমার কারণে কোহেলিয়া নদীতে ট্রলার ও নৌকা চলতে পারে না। মহেশখালীর মানুষের এসব দুঃখ দুর্দশার কথা বলার জন্য ঢাকায় অনেক প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। ভূমি সচিবদের সাথে বসেছিলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমাদের এখনও আন্দোলন করতে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, ‘কয়লা বিদ্যুতের নামে কিছু মানুষের সুবিধার্থে সরকার আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কোহেলিয়া নদী ওই অঞ্চলের একটি বৃহৎ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করে এখানকার ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কিন্তু মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সুবিধার্থে কোহেলিয়া নদীর বুক ছিড়ে রাস্তা তৈরি করে নদীটি ধ্বংস করা হয়েছে। এভাবে প্রকল্পের নামে নদী, জলাধার, প্রকৃতি, পরিবেশের তোয়াক্কা না করি তবে আমরা একটি অন্তঃসারশূন্য জাতি তৈরি করব।
একই কথা বলছেন বাংলাদেশ এনভায়রন্টম্যান্ট নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কোহেলিয়া নদী নামটিই কতই সুন্দর। এই সুন্দর নদীটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটি অভাবণীয়। বিশ্বাস করার মত নই। এটি সরাসরি দেখে মনটা খুবই ভেঙে গেল। কিভাবে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে একটি নদী হত্যা করতে পারে! নদী একটি জীবন্ত সত্তা। নদী রক্ষায় সবাইকে প্রতিবাদ করতে হবে। কোহেলিয়া নদীকে পুনরুজ্জীবিত করতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
তবে কুল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু কালাম আজাদ বলেন, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে নদী ভরাট হচ্ছে না। রাস্তা নির্মাণ ও ব্রিজ তৈরির কারণে নদীতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এছাড়া প্রকল্পের বর্জ্য ও পলি নদীতে আসার প্রশ্নই ওঠে না।
অপরদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, ‘কোহেলিয়া নদীকে বাঁচাতে খনন কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড দ্রুত কাজ শুরু করবে। প্রথম পর্যায়ের বন্দর নির্মাণের কাজ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও একটি বন্দর নির্মাণ করা হবে। যেটি কোহেলিয়া নদীর উপরেই করার পরিকল্পনা আছে।’
উল্লেখ্য, কোহেলিয়া নদীটি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া, হোয়ানক, মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নে অবস্থিত। এই নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সভ্যতা। নদীর সাথে মিতালি করেই যেন কাটে কয়েকলাখ মানুষের জীবন।