বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পেনশন স্কিম নিয়ে বড়-ছোট দ্বন্দ্বে সংঘর্ষ
সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) চলমান আন্দোলন কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বড়-ছোট দ্বন্দ্বে দুই গ্রুপ কর্মকর্তাদের মধ্যে বাকবিতন্ডা, মারামারির ঘটনা ঘটেছে।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) দুপুরে প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন এলাকায় এ সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে বরিশালের সুশীল সমাজ ও অবিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। তারা বলেছেন, কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন আচরণ ও অযোগ্যতার প্রমাণ এগুলো। এই অনাকাঙ্খিত ঘটনার বিচারের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার (২ জুলাই) বিকালে রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শফিউল আলমকে আহ্বায়ক ও রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খোরশেদ আলম ও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজ আলম। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে রেজিস্ট্রার বরাবর প্রেরণের জন্য বলা হয়।
ববিতে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের একপক্ষ সরাসরি কর্মকর্তা এবং অন্যপক্ষ ধীরে ধীরে প্রমোশন পেয়ে কর্মকর্তা হয়েছেন। যে কারণে প্রথম পক্ষের কর্মকর্তারা ডিরেক্ট অফিসার্স এসোসিয়েশন তৈরি করে দ্বিতীয় পক্ষের থেকে নিজেদের পৃথক ও বড় দেখাতে চান বলে অভিযোগ দ্বিতীয় পক্ষ অফিসার্স এসোসিয়েশন কর্মকর্তাদের। তারা উভয়েই সার্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় প্রত্যাহারের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছিলেন। ২ জুলাই মঙ্গল দখলকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের কর্মকর্তারা প্রথমে বাকবিতন্ডা এবং পরে মারামারিতে জড়িয়ে পরেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে। এ সময় উভয় গ্রুপের ১০ জন কমবেশী আহত হয়েছেন । তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে ।
হাসপাতালে ভর্তিকৃতরা হলেন : বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. তানজিম হাসান, সহকারী রেজিস্ট্রার তৌফিকুল ইসলাম রাহাত, সেকশন অফিসার মাহমুদুল হাসান, মিজানুর রহমান ও আবু সায়েম। অন্যদিকে ডিরেক্ট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও পরিকল্পনা দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর আবু হাসান, প্রকৌশল দপ্তরের উপপ্রধান প্রকৌশলী মুরশীদ আবেদীন, অর্থদপ্তরের ডেপুটি একাউন্টস অফিসার ইকবাল মিয়া এবং সহকারী রেজিস্টার আনোয়ার সাদাত হাসপাতালে ভর্তি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বেলা ১টার দিকে প্রশাসনিক ভবনের নীচতলায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স এসোসিয়েশন ব্যানার টানিয়ে কর্মবিরতি পালন করছিল। কিছু সময়ের পর ওই স্থানে ডিরেক্ট অফিসার্স এসোসিয়েশন লেখা ব্যানার নিয়ে তা ঝোলাতে আরেকটি গ্রুপ সেখানে অবস্থান নিতে চায়। এ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে বাগবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে দুই গ্রুপ মারামারিতে জড়িয়ে পরেন। পরবর্তীতে শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং পুলিশ এসে তাদের শান্ত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন।
এ বিষয়ে ডিরেক্ট অফিসার্স এসোসিয়েশনের ব্যানারের সভাপতি ও ববির অর্থ ও হিসাব বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক সুব্রত কুমার বাহাদুর জানান, গতকাল সোমবারও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কর্মবিরতি পালন করেছি। আজও তাই একইভাবে কর্মবিরতি পালন করতে প্রশাসনিক ভবন (১ম) এর নীচতলায় ব্যানার নিয়ে যাই। এ সময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স এসোসিয়েশনের নেতারা ওই ব্যানার ছিড়ে ফেলে বাগবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আরো একটি ব্যানার আনা হয়। সেই ব্যানারও তারা কেড়ে নিয়ে যায়। এরপর চেয়ার নিয়ে তারা আমাদের উপর হামলা চালায়। হামলায় আমাদের ছয় কর্মকর্তা আহত হয়েছে বলে জানান ডিরেক্ট অফিসার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সংগঠনের রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। তবে একটি সংগঠন যে কোন কারনে গড়ে উঠতে পারে। বৈধ অবৈধ বলতে কোন সংগঠন নেই। যারা সরাসরি কর্মকর্তা পদে রয়েছেন তাদের নিয়েই মুলত এ সংগঠন গড়ে উঠেছে। আর যারা ছোট পদ থেকে কর্মকর্তা হয়েছেন তারা রয়েছেন অপর গ্রুপে। এখানে তাদের মধ্যে আমাদের ব্যবধানটা অনেক বড়। এ কারনেই পৃথক সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে বলে দাবি করেছেন সুব্রত কুমার বাহাদুর।
এ বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স এসোসিয়েশন এর সভাপতি এবং ববির ডেপুটি রেজিস্ট্রার বাহাউদ্দিন গোলাপ জানান, তাদের সংগঠনটি বৈধ সংগঠন। সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে এবং তিনি অফিসার্সদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সভাপতি হয়েছেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা ৪টি সংগঠন বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখছে। হঠাৎ করে রাতারাতি একটি ব্যানার নিয়ে আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। এ সংগঠনটি গড়ে ওঠার মূল কারণ তারা পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আড় চোখে দেখছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট একজন কর্মচারীও অনার্স-মাস্টার্স পাশ। সেখানে সে ছোট পদে চাকরি নিয়ে তার কর্মক্ষেত্রে ধাপে ধাপে কর্মকর্তা হচ্ছেন। সেখানে তাদের নিয়ে কটাক্ষ এবং নতুন সংগঠন গড়ে তোলা সমোচিত হয়নি বলে জানান বাহাউদ্দীন গোলাপ।
হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, তারা গতকালও আমাদের সাথেই কর্মবিরতিতে অংশ নিয়েছেন। আজও কর্মবিরতি পালন করছিলেন। আকস্মিক তারা সংগঠনের নামে ব্যানার নিয়ে এসে প্রশাসনিক ভবনের নীচতলায় অবস্থান নেয়। এ সময় তাদেরকে অন্যত্র সরে যেতে বললে তারা তাদের অবস্থানে অনঢ় থাকেন। এ নিয়ে বাগবিতন্ডার এক পর্যায়ে ওই সংগঠনের কর্মকর্তারা চেয়ার নিয়ে আমাদের কর্মকর্তাদের উপর হামলা চালায়। হামলা প্রতিহত করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। এতে আমাদের পক্ষের ৪ জন আহত হয়েছে। এ ঘটনার বিচার দাবি করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাপ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন সয়ং বন্দর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ.আর. মুকুল জানান, ঘটনার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কর্মকর্তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। তাৎক্ষনিক প্রক্টর, শিক্ষক এবং পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরীণ, এ কারনে এ ব্যাপারে পুলিশ কোন হস্তক্ষেপ করবে না। তবে প্রক্টর জানিয়েছে যাতে এ ধরনের ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্য পদক্ষেপ নেবেন।
বিষটি নিয়ে বিব্রত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া কোনো বক্তব্য দিতে রাজী হননি তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল কাইউম জানিয়েছেন, হাতাহাতির আকস্মিকতায় আমিও হতভম্ব হয়েছি। তাৎক্ষনিক পরিস্থিতি শান্ত করা হয়েছে। এতে কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছেন। তবে এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য উভয় গ্রুপকে নিয়ে বৈঠক করা হবে।
এ দিকে এ বিষয়টি বরিশালে এখন মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক কর্মকর্তাদের এমন আচরণ হলে এদের কাছে কি শিখবেন শিক্ষার্থীরা? শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে এমন প্রশ্ন রেখেছেন বরিশালের সুশীল সমাজ ও অবিভাবকদের অনেকেই।
বরিশালের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও নগর চিন্তাবিদদের একজন কাজী মিজানুর রহমান বলেন, একটা দাবী আদায়ের জন্য আন্দোলন করছেন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের কর্মকর্তারা। তারা সেখানে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু কে ছোট কে বড় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তারা নিজেদের অযোগ্যতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আমিতো মনে করি এদের কারোই নেতৃত্ব দেয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই বলে জানান কাজী মিজান।
অন্যদিকে নগরীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডের বাসিন্দা ববির বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী আহনাফ এর বাবা আলতাফ পারভেজ বলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে শোনার পর থেকেই আমাদের লজ্জা লাগছে। কারণ, এখানে আমাদের সন্তানরা পড়ছে। ওরা তাহলে কি শিখবে। তিনি আরো বলেন, আমিতো মনে করি রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত বলেই এগুলো ঘটছে।
পুরো বিষয়টি বরিশালের শিক্ষার পরিবেশে প্রভাব ফেলবে বলে জানান এই অবিভাবক। এদিকে এ বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও ফেসবুক জুড়ে তুমুল নিন্দা ও বাকবিতন্ডা অব্যাহত রয়েছে।