চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে দেড় দশকে শিল্পনগরী বাস্তবায়নে সাফল্য দেখাতে পারেনি বিসিক

দেড় দশক আগে চট্টগ্রামে তিনটি শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। দীর্ঘ এ সময়েও শতভাগ বাস্তবায়নে যেতে পারেনি সংস্থাটি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে দূরদর্শিতার অভাব ছাড়াও মাটি ভরাটসহ বিভিন্ন সংকটে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে বিসিক কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একটি বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। মাটি ভরাটসহ নানা জটিলতায় আটকে যায় শিল্পনগরী স্থাপনের কাজ। কয়েক দফায় প্রকল্পের ব্যয় ও সময়সীমাও বাড়ানো হয়। ২০১৫ সালের ১২ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকল্প আকারে ২৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার মিরসরাই বিসিক প্রকল্প অনুমোদন হয়। ২০১৭ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হলেও এখনো সাত-আটটি প্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে গেছে। যদিও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সন্নিকটে গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্পনগরীর প্লট সংখ্যা ৮৮।

অপরদিকে চট্টগ্রামের রাউজান পৌর এলাকায় ৩৫ একর জমির ওপর ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিসিকের অপর প্রকল্পটির ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে একনেকে পাস হয়। ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় প্রকল্পের কাজ আটকে যায়। ওই সময়ে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। নানা সমস্যার কারণে আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন এবং শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। জুনে প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও এখনো শিল্পনগরীর বেশকিছু কাজ বাকি রয়েছে।

এ শিল্পনগরী স্থাপনে ব্যয় হবে ৭৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ১৮৪টি শিল্প প্লটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইউনিট স্থাপিত হচ্ছে। প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রমের আওতায় ৩৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে ৩০ লাখ ২২ হাজার ঘনমিটার ভূমির উন্নয়ন, ৩৭৫ বর্গমিটার প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, ৪৬ বর্গমিটার পাম্প ড্রাইভার কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এ শিল্পনগরীতে সর্বমোট ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে জানিয়েছে বিসিক কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের মধ্যে প্লট বরাদ্দে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে বিসিক কর্তৃপক্ষ।

শিল্পনগরী বাস্তবায়নে বিসিক সবচেয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সন্দ্বীপ প্রকল্পে। ২০১২ সালের ২০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে একটি বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের ঘোষণা দেয়া হয়। একই বছরের ২০১২ সালের ২০ মার্চ বিসিকের পরিকল্পনা বিভাগের একটি পরিদর্শন দল সন্দ্বীপ পরিদর্শন করেন। সন্দ্বীপের মুছাপুর ইউনিয়নে সম্ভাব্য প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে শিল্পনগরী নির্মাণে সবুজ সংকেতও দেয়। পরিকল্পনা বিভাগের গঠিত ওই কমিটি স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্বীপের প্রথম শিল্পাঞ্চল নির্মাণে ডিপিপি তৈরির অনুমোদন দেয়। কিন্তু বিদ্যুৎ সমস্যা ছাড়াও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রকল্পটি স্তিমিত হয়ে যায়। তবে ২০১৮ সালে সন্দ্বীপে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন হওয়ার পর নতুন করে ভাবতে শুরু করে বিসিকের পরিকল্পনা বিভাগ। ২০১২-১৩ মৌসুমে নেয়া প্রকল্পে ১০ একর জমিতে শিল্পনগরী স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমানে জমি অধিগ্রহণ ব্যয় তিন গুণ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্প ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে। প্রায় দ্বিগুণ ব্যয় ১০ একর জমিতে ৬৩টি শিল্প প্লট করার কথা ছিল বিসিকের। ২০১৯ সালে অক্টোবরে চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে বিসিকের পরিকল্পনা বিভাগে প্রকল্পটির একটি ডিপিপি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু নানা জটিলতায় এখনো প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পনগরী বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি জটিলতা দেখা দেয় বিনিয়োগ নিয়ে। ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদাসীন। ফলে অনেক ব্যবসায়ী প্লট নিলেও সময়মতো বিনিয়োগের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারে না। তাছাড়া বিগত কয়েক বছর দেশে ব্যাংক খাতের অর্থ সংকট, করোনাকালীন জটিলতার কারণে চট্টগ্রামের শিল্পনগরীগুলো সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মুখে পড়েছে বিসিক।

প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে যেতে বিসিকের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিক চট্টগ্রামের উপমহাব্যবস্থাপক মো. নিজাম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিসিক শিল্পনগরী নির্মাণ, প্লট বরাদ্দ শেষে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে যেতে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার জড়িত। চট্টগ্রামের শিল্পনগরীগুলো বাস্তবায়নে মূল সমস্যা ছিল ভূমি অধিগ্রহণ। আবার নির্মাণকাজ শুরুর পর মাটি ভরাট কাজও প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করেছে। প্রকল্পের কাজ শেষে প্লট গ্রহীতারা উৎপাদনে না যাওয়ার ক্ষেত্রে বিসিকের কোনো ভূমিকা থাকে না। ব্যাংক যদি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ (ঋণ) না দেয়, তবে প্লট নেয়ার পরও পরিপূর্ণ উৎপাদনে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।’ তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সময়মতো অর্থছাড় হলে যথাসময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *