চট্টগ্রাম

স্বজনপ্রীতির চারণভূমি চট্টগ্রাম ওয়াসা, চাকরি করেন এমডির ২০ আত্মীয়

চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিণত হয়েছে স্বজনপ্রীতির চারণভূমিতে। এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) ২০ জনেরও অধিক আত্মীয়-স্বজন।

এছাড়াও প্রতিষ্ঠানে রয়েছে এমডির নিজ এলাকা নোয়াখালীর অন্তত আরও ২০ জন। ফলে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নেন না তিনি।

টানা ৮ মেয়াদে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বে আছেন এ কে এম ফজলুল্লাহ। এত বছর ক্ষমতায় থেকে নিজে যেমন জড়িয়েছেন বিভিন্ন অনিয়মে তেমনি আত্মীয়-স্বজনরাও জড়িয়েছিলেন অনিয়মের সঙ্গে। এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো উদারতা দেখিয়েছেন বছরের পর বছর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ছাড়াও স্থায়ীভাবে চাকরি করছেন এমডি’র ২০ জনেরও অধিক আত্মীয়। ওয়াসায় বিভিন্ন পদে চাকরি করেন- এমন ২০ জনের তালিকা এসেছে বাংলানিউজের হাতে। যদিও এ স্বজনপ্রীতির বিষয়টি মানতে নারাজ এমডি।

শুধু আত্মীয়-স্বজন নয়, নিজ এলাকা নোয়াখালীর মানুষদেরও চট্টগ্রাম ওয়াসায় পুনর্বাসন করেছেন তিনি। তাই অনেকে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে ‘নোয়াখালী পুনর্বাসন কেন্দ্র’ বলেও উপহাস করেন।

এমডি’র আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে রয়েছেন রওনক জাহান নামে তার এক ভাগনি। যিনি কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২ এ চুক্তিভিত্তিক হিসাবরক্ষক পদে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এখনও ওই পদে তাকে বহাল রেখেছেন নিজ ক্ষমতাবলে। যার অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে ওয়াসার ফান্ড থেকে। কাগজে কলমে রওনক হিসাবরক্ষক পদে দায়িত্ব পালন করলেও কখনও অফিস করেন না।

রওনকের স্বামী অর্থাৎ সম্পর্কে এমডি’র ভাগনি জামাই আবু নোমান সিদ্দিকী আছেন সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে। তিনিও কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২ এ দায়িত্বরত ছিলেন। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে নাসিরাবাদ বুস্টার স্টেশনে। শুধু তা-ই নয়, এ প্রকৌশলীর জন্য একটি গাড়ি ও গাড়ি চালক নিযুক্ত করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ওয়াসার ভবন নির্মাণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে এখতিয়ার বহির্ভূত বিলে স্বাক্ষর করেন বলে অভিযোগ আছে সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে।

ওয়াসার এমডি’র আত্মীয়ের তালিকায় আছেন নাতনি লুৎফি জাহান। তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার পদে আছেন। তার স্বামী অর্থাৎ এমডি’র নাতনি জামাই শফিকুল বাসারও আছেন ওয়াসার সিস্টেম এনালিস্টের দায়িত্বে৷

এছাড়া এমডির ভাগনে আবু ইউসুফ কর্মরত আছেন বিক্রয় বিভাগের সহকারী প্লাম্বিং মিস্ত্রি হিসেবে। আরেক ভাগনি আফসানা নুর আছেন হিসাব সহকারী পদে। ভান্ডার শাখায় কম্পিউটার অপারেটর পদে আছেন এমডি’র ভাতিজা মোহাম্মদ আলী। আরেক ভাতিজা ইমরান খান আছেন মোহরা পানি শোধনাগারে উপ-সহকারী প্রকৌশলীর দায়িত্বে। ভাতিজি মেহেরুননেছা পপি আছেন মড-১ শাখায় উপ সহকারী প্রকৌশলী পদে। এমডির তালতো বোন আয়েশা হোসেন আছেন রাজস্ব তত্ত্বাবধায়ক পদে।

তালিকায় নাম আছে এমডির দূর সম্পর্কের ভাই মামুনুর রশীদের। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মিটার পরিদর্শক পদে। এছাড়া মামুনের ভাই জিল্লুর রশীদ আছেন সহকারি পাম্প অপারেটর পদে। মামুনের ভাগনি রাবেয়া বেগম ও নুরনাহার বেগম আছেন মিটার পরিদর্শক পদে। এমডির দূর সম্পর্কের আত্মীয় হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন মামুন। নিজের ভাই-বোন ছাড়াও চাকরিতে ঢুকিয়েছেন নিকট আত্মীয়দের। মামুনের খালাতো ভাই দিদার নামের একজনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে এমডি’র ব্যক্তিগত সহকারী পদে। অবসরে যাওয়ার পরও এমডি’র একক ক্ষমতায় এখনও চাকরি করছেন তিনি। দিদারের ভাই শাহ আলমও আছেন ওয়াসায়। দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী পাম্প অপারেটর পদে। তার (দিদার) আরেক ভাই মোরশেদ আলম আছেন সহকারী প্লাম্বিং মিস্ত্রি পদে।

জানা গেছে, আউটসোর্সিংয়ে চাকরি করেন এমডির আত্মীয় আরও অন্তত ১৫ জন। শুধু চাকরি নয়, ঠিকাদারীতেও বিস্তৃত এমডি’র আত্মীয়দের শিকড়। সরওয়ার জাহান নামে এমডি’র এক ভাগিনা আছেন ঠিকাদারি পেশায়, যিনি ওয়াসাকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারি করেন। সরওয়ার জাহানের প্রতিষ্ঠানের নাম জাহান এন্টারপ্রাইজ। সরওয়ার জাহানের বোন রওনক জাহান। সরওয়ার চাকরি না করলেও চাকরি দিয়েছেন বউ মৌ জাহানকে। চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কন্ট্রাক্টরের বিল পাস করানো তার কাজ।

সর্বশেষ এমডি’র শ্যালক হাফিজুর রহমানও দায়িত্বে আছেন চট্টগ্রাম ওয়াসায় স্যুয়ারেজ প্রকল্পের সঙ্গে লিঁয়াজো অফিসার পদে। প্রকল্পের কাজ চট্টগ্রামে চললেও তিনি থাকেন ঢাকায়।

শুধু আত্মীয়-স্বজন নয়, ওয়াসার চাকরিতে প্রাধান্য পেয়েছে নিজ এলাকা নোয়াখালী সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের মানুষ। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী প্রকৌশলী রিচার্ড নেলসন পিনারু। যার বাড়ি এমডি’র একই ইউনিয়নে। ১৫ বছর ধরে বিক্রয় বিভাগে দায়িত্বে আছেন পিনারু। তার বিরুদ্ধে ব্যারিস্টার কলেজ এলাকায় ১৫০টি অবৈধ সংযোগের তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদার তালিকাভুক্ত করার অনিয়মের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। নতুন ঠিকাদার তালিকাভুক্ত করার জন্য প্রতি ক্যাটাগরিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নাম ভাঙিয়ে ৪০-৫০ হাজার টাকা নেন তিনি।

এ ছাড়াও ওয়াসার এমডি’র একই বাড়ির বাসিন্দা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম। তিনিও নিয়োগ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন আত্মীয়কে।

চট্টগ্রাম ওয়াসায় নিজের আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এমডি বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এই অভিযোগ বেশ পুরোনো। মহিউদ্দীন চৌধুরীর সময়ও এই অভিযোগ উঠেছিল। পরে খোঁজ খবর নিয়ে দেখা যায়, এখানে বেশিরভাগই চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা। সুতরাং এ অভিযোগ ভিত্তিহীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *